বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থির। কয়েক বছর যাবৎ চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, মাছ এবং মাংসের মতো খাদ্যপণ্যগুলোর দাম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সাধারণ মানুষ এই পণ্যগুলো কেনার সামর্থ্য হারাতে বসেছে। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যার মধ্যে অন্যতম সিন্ডিকেট ব্যবসা, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সমস্যা। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার বা কমানোর দাবি ওঠা একেবারে যৌক্তিক।
জনগণের দুঃখ-কষ্টের বিবেচনা
আজকাল যে কোনো পণ্য কেনার আগে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে ‘আমার পক্ষে এত দামে কেনা কি সম্ভব?’ দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং খাদ্যপণ্যে অতিরিক্ত কর চাপানোর কারণে এই প্রশ্নটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। শ্রমজীবী মানুষ, দিনমজুর, সাধারণ কর্মচারী কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষরা পণ্য কিনতে গিয়ে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। তারা যখন চিড়া, পেঁয়াজ কিংবা টমেটো কিনে ঘরে ফেরেন, তখন এর মূল্য চিন্তা করে তাদের মন হয়ে ওঠে বিষণ্ন। দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে এখনো প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ গরিবের তালিকায়, যারা দারিদ্র্যের কারণে জীবন ধারণ করতে সমস্যার সম্মুখীন।
সঠিক সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি
সরকারের উচিত সিন্ডিকেট ভাঙার মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে সহায়তা করা। দেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ এবং ব্যবসায়ীদের সহায়তায় প্রকৃত বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব যা সরাসরি জনগণের কল্যাণে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা চালু থাকলে দাম কমে যাবে এবং এক্ষেত্রে মুনাফার হার কিছুটা কমলেও সরবরাহে কোনো অভাব হবে না। এই অবস্থায় সরকার যদি খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করে, তা হলে দ্রব্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং সাধারণ মানুষ সুবিধা পাবেন।’
আর্থিক লাভ বনাম আস্থা সংকট
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে ভ্যাট বা মূসক। এটি সরকারের ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তবে খাদ্যপণ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট আরোপ করলে আর্থিক লাভের বিপরীতে সরকারের ওপর জনআস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি
খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ করতে হলে জনআস্থার সংকট এড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেমন- স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ ও ভ্যাট আরোপের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি বা রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা। জনগণকে বোঝাতে হবে ভ্যাট আরোপের যৌক্তিকতা এবং এর মাধ্যমে কীভাবে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। মৌলিক খাদ্যপণ্যে কম হারে ভ্যাট আরোপ করা, যাতে নিম্নবিত্ত শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ভ্যাট থেকে অর্জিত অর্থ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হচ্ছে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং এর বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে হবে।
খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এটি এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে আর্থিক লাভের পাশাপাশি জনআস্থা অটুট থাকে। সরকারকে জনগণের অনুভূতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
অন্যথায় সাময়িক আর্থিক লাভের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে, যা জাতির সামগ্রিক অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং রোজার মাসের পীড়াদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্য কমানোর জন্য সরকারের সহায়তা খুবই প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের মুনাফার ক্ষতি না করে সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট কমাতে উদ্যোগী হওয়া। শুধু তখনই আমরা পাব সুখী এবং সহায়ক সমাজের সূচনা, যেখানে মানুষ নিরাপদে এবং শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে।