ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

অর্থনীতিতে সংকট ও সম্ভাবনা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ১৮:৪৮, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

অর্থনীতিতে সংকট ও সম্ভাবনা

বিগত ১৭ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস জানুয়ারি ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত  হয়েছে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংস্থাটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন্দরমিত গিল এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সংকটময় অবস্থায় আছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যাতে অর্থনীতির গতিশীলতা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব বাড়ানোর জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।  এসব কারণে চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
সংকট কাটাতে বাংলাদেশ সরকারের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। এর মধ্যে আছে, রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনে আয় বাড়ানো, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সঠিকভাবে কার্যকর করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়া। কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যে মন্দা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঋণ পরিশোধের চাপসহ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মহামারি পরবর্তী ধাক্কা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। সেই জটিল পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো বেরুহতে পারেনি। যদিও বাংলাদেশ এসব সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু সংকটের প্রভাবে জনজীবনে যেসব আঘাত লেগেছে সেগুলোর উপশম এখনো হচ্ছে না। এ জন্য সরকারকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে, রাজস্ব আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পথ সুগম করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের  বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। কিন্তু ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে ওইসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ফলে সেসব দেশ থেকে আয়ও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে আগামীতে এ খাতে নানা জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণেও মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
এর আগে অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে সৃষ্ট অস্থিরতায় প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে। এ হার ৪ শতাংশ হতে পারে। একই কারণে আইএমএফও প্রবৃদ্ধির হার কমার পূর্বাভাস দিয়েছে। তারা বলেছে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৪ শতাংশ হতে পারে। নতুন পূর্বাভাসে বিশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধির হার সামান্য বাড়িয়েছে। এদিকে জানুয়ারির শুরুতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনা মহামারির পর ও বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার কমেনি। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো বাজারে তেমন কাজ করছে না । উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, যার ফলে মন্থর হয়ে গেছে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি। দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমে এলেও বাংলাদেশে তা উচ্চপর্যায়ে স্থির রয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও সংকোচনমূলক করা হয়েছে মুদ্রানীতি। তবে চলতি বছরও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হতে পারে। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লেও বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে তা কমেছে। এটি মুদ্রাবাজার চাপে থাকার প্রতিফলন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেলে তা রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে সবেচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ। আর দেশের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই হয় ইউরোপে। গত মাসে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমায় আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে আসতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে। এর আগে গত অক্টোবরে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ দেয় সংস্থাটি। এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্তর্র্বর্তী সরকারও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
গতকাল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কারণে এ বছর গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমাতে হয়েছে। কারণ অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়ানো হলেও কমানো হয়েছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের নীতি অনিশ্চয়তা এর বড় কারণ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ার কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও শিল্প কার্যক্রম নিকট ভবিষ্যতে মন্থর থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ফের বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পাশাপাশি আর্থিক খাতের সংস্কার সফল হলে এবং ব্যবসা পরিবেশের উন্নতি ও বাণিজ্য বাড়লেই এটি সম্ভব হবে। মূল্যস্ফীতি কমে এলে সেটিও বেসরকারি ভোগ্যব্যয় বাড়াতে সহায়তা করবে। তবে আগামী অর্থবছরেও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি দুর্বল অবস্থানে থাকবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বেকারত্ব এখনো উচ্চমাত্রায় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদের মতে, ‘২০২১-২২ সালের দিকে জ্বালানি তেলের দাম ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখলেও এর পরের সময়গুলোয় দেশের নীতিগত ভুলের কারণেই মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়নি। কারণ জ্বালানি ও ডলারের দাম বাড়ার বিষয়টি সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশ কমাতে পারলেও বাংলাদেশ কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি? তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে বাহ্যিক কারণের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এ বিষয়টির স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক। অতীতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হলেও সেটি সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি, বরং সরকার উল্টো পথে হেঁটেছে। সে সময় টাকা ছাপিয়ে সরকার ও কিছু ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ডলারের বিনিময় হারের কারণে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়েছে। শুধু  বৈশ্বিক কারণে নয়, সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিও ডলারের বিনিময় হার বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।’ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে সরকার বাজেটের আকার কমানোর পাশাপাশি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটলেও বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগের কৌশলই প্রয়োগ করছে। বাজারে যে অব্যবস্থাপনা চলছে সেটি দূর করার জন্য এখনো কার্যকর ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। বাজারে খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হলেও খেলার কোনো পরিবর্তন হয়নি।  আগের মতোই পুলিশ ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। অথচ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। মার্কেট পুলিশিং দিয়ে বিশ্বের কোথাও বাজার স্থিতিশীল করা যায় না, বরং এতে আরও অস্থিরতা বাড়ে। বাজারে নজরদারির ক্ষেত্রে কত দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, কী পরিমাণ পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর মজুদ কেমন আছে, বাজারে নতুন বিক্রেতার অন্তর্ভুক্তির পথ কতটা মসৃণ; সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রভাব খর্ব করতে হবে।

×