ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের কারসাজি

সবজিতে স্বস্তি ফিরলেও চাল ভোজ্যতেলে উল্টা চিত্র

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:০৭, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

সবজিতে স্বস্তি ফিরলেও চাল ভোজ্যতেলে উল্টা চিত্র

.

শাক-সবজির দামে স্বস্তি ফিরলেও উল্টোচিত্র বিরাজ করছে চাল ভোজ্যতেল ও মুরগির বাজারে। ভালোমানের প্রতি কেজি মিনিকেট নাজিরশাইল ও চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। এ ছাড়া  বেড়েছে মুরগি ও মাছের দাম। আটা, ডাল, চিনি, ডিমের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। কমেছে আলু ও পেঁয়াজের দাম। আদা, রসুন ও অন্যান্য মসলা পাতির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে বেশিরভাগ সবজি এখন বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এতে সবজি বাজারে খুশি ভোক্তারা। 
শুক্রবার ঢাকার বাজারে প্রতি  কেজি বেগুন ৪০ থেকে ৫০, শিম ৩০ থেকে ৫০, কাঁচা পেঁপে ২৫ থেকে ৩০, শসা ২৫ থেকে ৩০, উচ্ছে ও করলা ৫০ থেকে ৬০, মুলা ১৫ থেকে ২০, বরবটি ৫০ থেকে ৬০, গাজর ৪০ থেকে ৪৫ এবং মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৩০ টাকায় কেনা যাচ্ছে। প্রতি পিস ফুল কপি ও বাঁধাকপি মানভেদে ১৫ থেকে ২০ টাকা এবং লাউয়ের পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আরও দাম কমেছে আলুর। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় এসব সবজি ৮০-১০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে ভোক্তাকে। ঢাকার খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচা বাজার থেকে নিত্যপণ্য কিনছিলেন শাজাহানপুরের বাসিন্দা আজমল হোসেন। তিনি জানান, সবজিতে স্বস্তি ফিরলেও উল্টোচিত্র বিরাজ করছে চাল, ভোজ্যতেল ও মুরগির বাজারে। উৎপাদন ও আমদানি ভালো হওয়ার পরও চালের দাম কমছে না। 
তিনি জানান, চালের দাম না কমায় কষ্টে আছেন নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষ। এ ছাড়া শুল্ক কমানোর পরও ভোজ্যতেলের দাম কমেনি। বরং প্রতি সপ্তায় একটু একটু করে বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ছে। পাঁচ লিটারের বোতল সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৮৯০ টাকায়। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ১৭০-১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে বাজারে কঠিন নজরদারি প্রয়োজন। অন্যথায় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে যাবে নিত্যপণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের শুরু থেকেই এবার চালের বাজার ছিল চড়া। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তা আরও বেড়ে যায়। এর পর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। গত সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে দাম। বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের। এ ধরনের চালের ভোক্তা সাধারণত মধ্যবিত্ত। গত শুক্রবার ঢাকার বাজারে খুচরা পর্যায়ে এ দুই জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকায়। এ ছাড়া মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫৫-৬৫ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) জাত ও মানভেদে বিক্রি হয়েছে কেজি ৭৫-৯০ টাকা দরে। মাস তিনেক আগে মোটা চালের  কেজি ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এক মাসের ব্যবধানে মানভেদে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ১০ টাকা। 
এদিকে, ভরপুর উৎপাদন, শুল্ক কমে তলানিতে, আমদানির দরজাও খোলা, পাশাপাশি  জোরদার বাজার তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সরকারের এতসব আয়োজনেও বাগে আসছে না চালের বাজার। বিফলে যাচ্ছে সরকারের ইতিবাচক সব উদ্যোগ। খাদ্যশস্য মজুতেরও আছে নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, সেই নিয়মের ধার না ধেরে হাজার হাজার টন চাল গুদামে ভরে রেখেছেন উৎপাদন এলাকার মিলার ও মজুতদাররা। চালের সংকট না থাকলেও বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিমভাবে দামের ঘোড়া ছোটাচ্ছেন তারা। এ কারসাজির সঙ্গে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধা পাওয়া বড় মিলার ও উৎপাদন অঞ্চলের কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী জড়িত। ঢাকার বাদামতলী, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও কাওরান বাজারের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীও রয়েছেন এই চক্রে। সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিল বা বাজারে চালের কমতি নেই। সরকারকে চাপে রাখার  কৌশল হিসেবে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে,  দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। এতে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। 
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এর আগে বন্যায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে এখন চালের আমদানি বেড়েছে। কিন্তু এর কোন ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ছে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে চালের মজুত রয়েছে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন। তবে সরকারের নিরাপত্তা মজুত হিসেবে সাধারণত ১১ লাখ টন চাল রাখার কথা বলা হয়ে থাকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য বাজেট ২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাকি ৭ লাখ ৫০ হাজার টনের জন্য আরও ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে। 
এদিকে, চালের মতো দেড় মাসের বেশি সময় ধরে মুরগির বাজার বাড়তি। প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২০০  থেকে ২২০ টাকায়। আর সোনালি জাতের মুরগির কেজি কিনতে হলে কেজিপ্রতি খরচ পড়বে ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকা। ডিমের বাজার স্থির রয়েছে। ফার্মের প্রতি ডজন ডিম কেনা যাবে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, চারদিকে শীতকালীন উৎসব বিশেষ করে পিকনিক, বিয়ে-শাদীসহ সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বেড়ে যাওয়ায় মুরগির চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে দাম বাড়ছে। এ ছাড়া বাজারে দেশি জাতের মাছের সরবরাহ বাড়লেও দাম কমছে না। একটু বড় সাইজের প্রতি কেজি শৌল মাছ ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বোয়াল, আইর ও চিতল ও ইলিশ মাছ কিনতে ভোক্তাকে বেশি টাকা কিনতে হচ্ছে। ক্রেতারা জানিয়েছেন, শীতে শোল, বোয়াল, আইর ও চিতল মাছের চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু  দাম এত বেশি যে সাধারণ মানুষ এসব মাছের স্বাদ নিতে পারবে না। তবে বাজারে গরু ও খাসির মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

×