উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে
গত বছরের তুলনায় এবার শীতকালীন সবজির মূল্য অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এর পরও রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। কারণ চৈত্র মাসে বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যাবে। দেশে প্রায় তিন বছর হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এদিকে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার চিন্তা। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ালে পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মুদ্রানীতি জানুয়ারির শেষ ভাগে হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ঘোষণা করা হবে। এবারের মুদ্রানীতির টার্গেট হলো টাইট মনিটারি পলিসি করা বা মুদ্রাস্ফীতি (ইনফ্লেশন) কমানো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জনকণ্ঠকে বলেন, মনিটারি পলিসি নিয়ে এবার আমাদের কোনো চিন্তা নেই। আমরা অনেকটাই চিন্তামুক্ত। এখন বাজারে সব কিছুর দাম সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬। এই হার গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। শুধু তা-ই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণপত্রের নিষ্পত্তি হয়েছে কম।
ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়, এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম। অন্যদিকে মূলধনী ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এ সবকিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে যা ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামবে। সেটা হলে তা হবে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনি¤œ প্রবৃদ্ধি, কেবল করোনার সময় অর্থ্যাৎ ২০২০-২১ অর্থবছর বাদে।
নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত পাঁচ মাসে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট করে তিন দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, বর্তমানে যা ১০ শতাংশ। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হচ্ছে না, বরং এর প্রভাবে বাজারে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও তলানিতে নেমে এসেছে, অর্থনীতিতে যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন এক ধরনের স্ট্যাগফ্লেশন (নি¤œ প্রবৃদ্ধি+উচ্চ মূল্যস্ফীতি+উচ্চ বেকারত্ব) চলছে অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়।
তবে অনেকেই মনে করেন, উন্নত বিশ্বে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সম্ভব নয়। যেসব দেশের ৯০ শতাংশই ভোক্তাঋণ, সেখানে তা সম্ভব হতে পারে। তারা বাড়ি, গাড়িসহ নানা কাজে ঋণ নেন। ফলে সেসব দেশে সুদহার বাড়িয়ে ভোগব্যয় কমানো যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ঋণই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেওয়া হয়।
এখানে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সরকারি তথ্যেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্টো বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে ঠেকেছে, অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে সর্বনি¤œ অবস্থায় নেমেছে। খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব।
অর্থনীতিরা মনে করেন, নীতি সুদ বৃদ্ধি করে এখন পর্যন্ত লাভ হয়নি। নীতি সুদ বৃদ্ধির কী প্রভাব পড়বে, তা খতিয়ে দেখা হয়নি। ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সময়ও খতিয়ে দেখা হয়, সেই ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা কতটুকু। কিন্তু নীতি সুদ বৃদ্ধির মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তা করা হয় না। এ ছাড়া ভ্যাট বৃদ্ধি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সমালোচনা করেন তিনি।
এদিকে গভর্নর আহসান মনসুর ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শীঘ্রই বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের মার্জিন ছাড়াই ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে নেওয়া মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন সফল হচ্ছে না। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মজুত পরিস্থিতির দিকেও নজর দিতে হবে। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে ১১ লাখ ৭৮ হাজার টনের বেশি ধান, চাল ও গম মজুত ছিল।