ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১

নতুন স্বপ্নে সমতলের চা চাষিরা

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ০০:৪০, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

নতুন স্বপ্নে সমতলের চা চাষিরা

.

দেশের উত্তর জনপদে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর সমতলের অন্যতম চা অঞ্চল হিসেবে এরই মধ্যে দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলা। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি ও দেশের সবচেয়ে অনুন্নত এলাকাগুলো এখন চায়ের বাগানে ভরে গেছে। সৃষ্টি হয় চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য। দেশের বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে এই সমতলের চা। বলতে গেলে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুরে উঁচু সমতল ভূমিতে অর্থকরী ফসল সবুজ চা চাষ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নানান নাটকিয়তা চলছিল উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় উৎপাদিত সমতলের কাঁচা চা পাতা ঘিরে। গত দুই বছরে চা-চাষিরা হয়েছে মূল্য বঞ্চিত। এবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে নতুন স্বপ্ন দেখছেন চা বাগানিরা। 
চা-চাষি সারোয়ার জাহান ও নুরুজ্জামান নুর জানালেন, বাগানগুলোতে এখন চলছে প্রুনিং (গাছ পরিপূর্ণ হওয়ার পর গাছকে সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক রাখা এবং উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গাছের কোনো অংশ যেমন- কা-, শাখা, পাতা, ফুল কেটে দেয়া)। এই কার্যক্রম চলবে  দুই মাস। এ সময়টিতে চা পাতা উত্তোলন হবে না। সে কারণে টানা দুই মাস চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।  
বাংলাদেশ চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফ খান বলছিলেন  চায়ের নতুন বছরের সঙ্গে চায়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে টানা দুই মাস পঞ্চগড়ের চা প্রক্রিয়াজাত কারখানাসহ পাতা উত্তোলন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে সমতলের এই চা নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখলেও গত দুই বছরের অধিক সময় ধরে বাগান মালিকদের পাতার ন্যায্য মূল্য না পাওয়াসহ কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে চোরাইপথে প্রক্রিয়াজাত চা বিক্রির অভিযোগ ওঠে। এতে চা সম্প্রসারণে আগ্রহ হারায় বাগান মালিকরা। তবে জেলা প্রশাসন ও চা বোর্ডের উদ্যোগে সমস্যা নিরসনের পর এখন নতুন স্বপ্নে বাগান মালিকসহ শ্রমিকরা। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে প্রুনিং বা ছাঁটাই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে যেমন নতুন ভাবে তৈরি হবে কাঁচা চা পাতা তেমনি আগামী দুমাস পরিচর্যায় চায়ের গুণগত মান নিশ্চিতে ভূমিকা পালন করবে।
উত্তরবঙ্গের সমতলের চা শিল্পের সামগ্রিক তথ্য ও প্রযুক্তি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতেই এ সমতলের চা শিল্পের ইতিহাস, চা শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ চা বোর্ডের ভূমিকা, সমতলের চায়ের পরিসংখ্যান, চা চাষিদের জীবনযাত্রা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, কতিপয় সফল চা চাষির সফলতার গল্প, চা শ্রমিকদের তথ্যাবলী, চা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমতলে টি টরিজমের সম্ভাবনা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি মোবাইল অ্যাপ, ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল, চা বোর্ড প্রদত্ত সেবাসমূহের লিঙ্ক এবং সমতলের চা চাষের সাফল্যের সামগ্রিক স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্র সন্নিবেশ করা হয়েছে একটি অ্যাপ কার্যকর রয়েছে ও নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। দেখ যায়, টি সফট মোবাইল অ্যাপিকেশন অ্যাপের মাধ্যমে কৃষক থেকে শুরু করে চায়ের নিলামের পরিসংখ্যান সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়। এই সফটওয়্যারে ১৪ দিনের একটি হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ৫৩ হাজার ৬০৪ দশমিক ৭৬ কেজি চা নিলামের জন্য অকশন সেন্টারে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। যার প্রতিদিনের গড় মূল্য ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬১ টাকা ৯০ পয়সা। যেখানে রাষ্ট্রের গড় প্রতিদিন রাজস্ব আয় হয় ১৩ লাখ ৭২ হাজার ২৮১ দশমিক ৮৯ টাকা।
চা চাষিদের অসন্তুষ্টি ও চাষ কমে আসার কারণ হিসেবে দেখা গেছে ফ্যাক্টরির ক¤িপটিশন না থাকা। খারাপ কোয়ালিটি এবং চোরাই পথে চা বিক্রির কারণে চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চাষি নসিব ও শাহিন জানান, তারা ভালোমানের চা দেয়ার পরেও বেশ কিছু  ফ্যাক্টরি তা ঠিকমতো নেয়নি। বিগত বছরগুলোতে আমরা ফ্যাক্টরির নানা চক্রান্তের শিকার হয়েছি। বর্তমানে কিছুটা সমস্যা কেটেছে। এখন নতুনভাবে চা বাগানগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। যেহেতু দেশে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, আমরা সরকারের কাছে আশা করি, নতুন মৌসুমে যাতে আমাদের কাঁচা পাতার ন্যায্য মূল্যসহ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। এজন্য আমরা ভালোমানের পাতা তৈরিতে কাজ করছি। 
সংশ্লিষ্টতা বলছেন, গত মৌসুমে ১ কোটি ৭৯ লাখ কেজি চা উৎপাদন হলেও চলতি মৌসুমে তা কমেছে। কম হওয়ার কারণ হিসেবে আমরা তিনটি কারণ পেয়েছি। তা হলো-চাষিদের ন্যায্য মূল্য না দেওয়া, খরতাপ ও চোরাই পথে চা বিক্রি। অপরদিকে পঞ্চগড়ের চায়ের মান কীভাবে আরও ভালো করা যায় সে লক্ষ্যে সব সমস্যা নিরসনে কাজ করে যাচ্ছি। এতে করে নতুন মৌসুমে সুন্দর গুণগত মানের চা পাতা পাওয়া যাবে। এটি হলে বাগান মালিক চা চাষিরা ন্যায্য দাম পাবেন।
উল্লেখ্য, ২০০০ সাল থেকে সমতল ভূমির পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারীতে ১০ হাজার একর জমিতে চা উৎপাদন শুরু হয়। এদিকে গেল বছরে প্রচন্ড খরতাপ ও বাগান মালিকদের চা পাতার ন্যায্য মূল্য না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে চলতি মৌসুমে গেল বারের চেয়ে ৩৪ লাখ কেজি চা কম উৎপাদন হয়েছে। অপরদিকে ১ হাজার একর জমির চা বাগানে নষ্ট করেছে বাগান মালিকরা।পঞ্চগড় জেলায় চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে ২৯টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে ১টি। নীলফামারী, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরে চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলার দাবি করেছে এই জেলাগুলোর চা চাষিরা। তারা বলছেন তাদের উৎপাদিত কাঁচা পাতা তুলে পঞ্চগড় বা ঠাকুরগাঁও প্রেরণ করতে হয়। এতে দাম কম পাচ্ছি আমরা। তিন জেলায় নতুন করে চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে চা বাগারে পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে নতুন মৌসুমের সঙ্গে সব সংকট নিরসনসহ চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে চা বোর্ড ও জেলাপ্রশাসন।

×