.
রোজা সামনে রেখে ইফতারির প্রধান উপকরণ ছোলার দাম বাড়ছেই। ছোলার পাশাপাশি ডাল জাতীয় অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও বাড়তির দিকে। রোজার আগে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে পালিত হবে পবিত্র শবেবরাত। শবেবরাতে হালুয়া-রুটির মতো খাদ্যপণ্য তৈরিতে ছোলাসহ ডালজাতীয় খাদপণ্যের প্রয়োজন পড়ে। এ অবস্থায় একটু ভালোমানের প্রতিকেজি ছোলা বর্তমানে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকায়। যা গতবছরের তুলনায় কেজিতে ২৮-৩৫ টাকা বেশি। সরবরাহ পরিস্থিতি না বাড়লে রোজার আগে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি হতে পারে বাজারে। মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজারে নজর বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
জানা গেছে, রমজানের চাহিদাকে পুঁজি করে প্রতি বছর দেশে ছোলার দাম বাড়িয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, দাম বৃদ্ধির এই কারসাজির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অসাধু একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছোলা আমদানি করে থাকেন। এ ছাড়া পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কারসাজি থাকে। ফলে রোজা আসলে বেড়ে যায় ছোলার দাম।
সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, শনিবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলা মানভেদে ১১৮-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রতি কেজিতে ২৮-৩৫ টাকা বেশি। অর্থাৎ গত বছর এই সময়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকায়। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে রোজার আগে ছোলার দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার দাম বেড়ে যাওয়ায় মসুর ডাল ও ছোলার মজুত এবং সরবরাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে মনিটর করার জন্য সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
মসুর ডাল ও ছোলা ছাড়া আসন্ন রমজান মাসে অন্যান্য সকল পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে করছে বিটিটিসি। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা এক চিঠিতে এ সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে রমজানে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এমন সকল পণ্যের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজার দর, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে আমদানির প্রকৃত পরিমাণ ও এইসময়ে আমদানির জন্য কী পরিমাণ এলসি খোলা হয়েছিল এবং রমজান মাসের চাহিদার তথ্যসহ একটি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। সেহরি ও ইফতারের সময় বাড়তি চাহিদার কারণে রমজান মাসে ছোলা, খেজুর, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল, চিনির চাহিদা অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি থাকে। এর প্রত্যেকটি পণ্যই পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। যে কারণে এসব পণ্য যাতে রমজান শুরুর আগেই পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হয়, সেজন্য সরকার ইতোমধ্যে শুল্ক-কর কমানো, এলসি মার্জিন কমানো, বন্দরে দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ২.৫১ লাখ টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে- যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬১ হাজার টন বেশি। এই সময়ে ৪৮ হাজার ৯৮০ টন ছোলা আমদানি হয়েছে- যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ হাজার ৫৩৪ টন বেশি। পণ্য দুটির আমদানি বেশি হওয়ার পরেও মজুত ও সরবরাহ মনিটর করার কথা বলেছে ট্যারিফ কমিশন। কারণ ইতোমধ্যে বাজারে ছোলার দাম বাড়ার পাশাপাশি ডাল জাতীয় পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ট্যারিফ কমিশন বলছে, মসুর ডালের দাম গত বছরের তুলনায় না বাড়লেও বর্তমানে ছোলা বিক্রি হচ্ছে গত বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি দামে। সংস্থাটির মতে, ছোলা ও মসুর ডালের চাহিদা থাকে এক লাখ টন করে। রোজাদারদের বেশিরভাগই তাদের ইফতারে ছোলা রাখেন। মসুর ডালের চাহিদা সৃষ্টি হয় হালিমসহ অন্যান্য ইফতার তৈরির উপকরণ হিসেবে। মসুর ডাল ও ছোলার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বাজারে এ দুটো পণ্যের মজুত ও সরবরাহ মনিটর করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে, রমজানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে কমিশন মনে করছে। এদিকে রমজানে ছোলাসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চারটি বিভাগের ৩১টি জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়ে এই নির্দেশ দেন তিনি। ওই সময় ড. ইউনূস বলেন, সামনেই রমজান আসছে, রমজানকে কেন্দ্র করে বাজারমূল্যের দিকে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। শুধু বাজারমূল্য নয়, জিনিসপত্র আনা নেওয়া আরও কীভাবে সহজ করা যায়, সে বিষয়েও কাজ করার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন।
জানা গেছে, রমজান মাস ছাড়া বছরে প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার টন ছোলার চাহিদা রয়েছে দেশে। তবে রোজায় ছোলার চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। শুধু রমজান মাসেই বাড়তি চাহিদা মেটাতে দরকার হয় এক লাখ ২০ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টন ছোলা। কিছু ব্যবসায়ী এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দাম বাড়িয়ে থাকেন। রোজার দেড়-দুই মাস আগেই তারা অযৌক্তিকভাবে ছোলার দাম বাড়িয়ে দেন। ছোলার মতো অ্যাংকর ডালের চাহিদাও বেশি থাকে রমজানে। এক-দেড় মাসের ব্যবধানে এ জাতের ডালের দামও বেড়ে গেছে। টিসিবির তথ্যমতে, বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি মসুর ডাল ১০৫-১৪০, মুগডাল প্রতি কেজি ১৩০-১৮০, অ্যাংকর ডাল প্রতি কেজি ৬৫-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে বছরে সব ধরনের ডালের চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন। কিন্তু উৎপাদন হয় এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। বাকিটা আমদানি করতে হয়। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে চাষযোগ্য জমির মাত্র দুই দশমিক ৪০ শতাংশ জমিতে ডাল চাষ হয়। অন্য ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, উন্নত জাত ও বীজের অপর্যাপ্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিযন্ত্রের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে ডালের উৎপাদন কম। ফলে বছর বছর আমদানির পরিমাণ বাড়ছে।
মৌলভীবাজারে ডাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজার একটু চড়া। এ কারণে ছোলাসহ সব ধরনের ডালজাতীয় পণ্যের দাম বেশি। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক হাজী মো. আবুল হাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা থাকার পরও ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে সময়মতো অনেক ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্য দিয়ে দেশে নিয়ে আসতে পারবে না। এ ছাড়া ডলারের দাম বাড়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। এর ফলেই মূল্যস্ফীতি। এ অবস্থায় ছোলাসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তবে কোনো ব্যবসায়ী যাতে অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ না নিতে পারেন সেই দিকে আমরা নজর রাখছি।
জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চাহিদার ৮০ শতাংশ ছোলা আমদানি করা হয়। বাকি ছোলা ভারত থেকে আমদানি হয় স্থলবন্দর দিয়ে। এ ছাড়া কানাডা, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেন, তানজানিয়া, মিয়ানমার থেকেও কিছু ছোলা আমদানি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ভারত থেকেই বেশি আমদানি হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে জানা গেছে, জানুয়ারিতে পুরোদমে রোজার জন্য ছোলা আমদানি হবে। ফলে সংকট হবে না। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমদানি বাড়াতে এলসি সহজ করতে হবে। তবে রোজার আগে কিছু ব্যবসায়ী কারসাজির চেষ্টা করেন। সেজন্য বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।