ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

কাঁচামালের অভাবে বড় বড় শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধের পথে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২১:০১, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

কাঁচামালের অভাবে বড় বড় শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধের পথে

ছবি- সংগৃহীত

কতিপয় ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো। এলসির অভাবে কাঁচামালও আমদানি করতে পারছেন না তারা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যহত হতে পারে। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  


তারা বলেন, কিছু ব্যাংকের বিশেষ করে ইসলামীক শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার পাশাপাশি চলতি মূলধনের ঘাটতি, ডলারের সংকট ও উচ্চমূল্য, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে চরমভাবে ভুগছে শিল্পকারখানাগুলো। যার কারণে দেশের তেল-চিনিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন, রড-সিমেন্টসহ নির্মাণশিল্পের তৈরি উপকরণ, ওষুধ, সিরামিক ও বস্ত্র খাতের মতো বৃহৎ শিল্পগুলোতে উৎপাদন ব্যাপক হারে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 


তারা বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকার প্রবাহ কমানো এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্প বাণিজ্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে নতুন শিল্প স্থাপন আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি।


শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। তারপর দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা। কিন্তু সেটির বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটায় চতুর্মুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশের শিল্পখাত। তারা আরো বলেন, দেশের বেশ কয়েকটি বড় বড় শিল্পগ্রুপ ইতোমধ্যে এলসি খুলতে না পেরে তাদের উৎপাদন কমিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এর মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক ও ঢাকার কয়েকটি শিল্পগ্রুপ অন্যতম। যারা বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল এনে পণ্য উৎপাদন করে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছে অথচ তাদের অনেক ব্যাংক শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়া সত্ত্বেও এলসি করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ক্রমেই এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হচ্ছে।

বর্তমানে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ব্যাংকে বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এলসি, বিদেশি ব্যাংক (এডিডি) কনফারমেশন করছে না। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সামনে রমজান মাস, দেশের ভোগ্যপণ্য চাহিদা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু সেই অনুযায়ী এলসি খোলা এবং তার বিপরীতে মাল শিপমেন্টের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বড় বড় শিল্পগ্রুপের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব।

অতি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্পগ্রুপগুলোর কোনো এলসি না করে শুধু পূর্ববর্তী ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে দেশবন্ধু গ্রুপের কথা। গ্রুপটির অধীনে ২৮টি কোম্পানির প্রায় ১৭ ধরনের শিল্প-কারখানা রয়েছে, যেখানে ২৫ হাজারের (বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পসহ) বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকগুলো কিছু দিন থেকে শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়ার পরেও এলসি দিচ্ছে না। এমনকি সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট কন্ট্রাক্টের আওতায় কাঁচামাল আমদানি করতেও সহায়তা করছে না। যদিও এতে ব্যাংকগুলোর কোনো প্রকার দায় সৃষ্টি হয় না। 


এসব বিষয় তুলে ধরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে দেশবন্ধু গ্রুপ। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে যথাযত নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর ০৩০০২৬৯০০৭৩০০০০১২৪-১৫৪। একইভাবে গত ২৮ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও একটি চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর ৫৩২০৪০৩৩৩৮০০১২৪২৯৩।

সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়, যার স্মারক নম্বর বিআরপিডি(পি)/৬৬১/১৩/আরআর(এম)/২০২৪-১১০০৮।

এ প্রেক্ষিতে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নং ১৬/২০২২ অনুযায়ী গ্রুপটির লোন রিসিডিউল করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যাংককে চিঠি দেয় দেশবন্ধু গ্রুপ। অতি আশ্চর্যের বিষয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি- এ তিনটি ইসলামী ব্যাংক অদ্যাবধি রিসিডিউল না করে বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে ক্লাসিফাইড হিসেবে প্রদর্শন করেছে। 


এ অবস্থায় বিষয়টি সুরাহার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় দেশবন্ধু গ্রুপ। মাননীয় হাইকোর্ট সার্বিক দিক বিবেচনা করে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠির প্রেক্ষিতে দেশবন্ধু গ্রুপের লোনগুলো রিসিডিউল করে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য নির্দেশনা দেন। 


এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখিত তিনটি ইসলামী ব্যাংককে দেশবন্ধু গ্রুপের কোম্পানিগুলোর সুদ মওকুফ করে ব্যাংক হিসাবগুলো নিয়মিত করণ এবং নিয়মিত ব্যাংকিং কার্যক্রম করার জন্য চিঠি দেয়,  যার স্মারক নং বিআরপিডি(ডি-১) পি/৬৬১/১৩/আরআরএম/২০২৪-১১৫৫৬।

এই চিঠির প্রেক্ষিতে দেশবন্ধু গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের চিঠি দেয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ব্যাংকগুলো তা না করে বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এবং দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা  দেখা দিয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। দেশবন্ধু গ্রুপের সঙ্গে উল্লেখিত তিনটি ব্যাংকের লেনদেনের একটি ফিরিস্তি তুলে ধরা হলো-


দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’র সঙ্গে, ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’র সঙ্গে এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি’র সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ২০১৭ সাল থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট তিন হাজার ৯৩৪ দশমিক ৪০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করে তিন হাজার ৬০৫ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২০১৯ সাল থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপের পাঁচটি কোম্পানির অনুকূলে মোট এক হাজার ৫৪৯.৮১ কোটি টাকা ঋণ দেয়। দেশবন্ধু গ্রুপ পরিশোধ করে এক হাজার ১৪৬.৩৩ কোটি টাকা।

একইভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ২০২৩ সাল থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশবন্ধু সুগার মিলসের অনুকূলে মোট ৭৫৩.৭০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। দেশবন্ধু গ্রুপ পরিশোধ করে ৩৮০.৮৭ কোটি টাকা। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী গ্রুপটি ডলারের বিপরিতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী এই ক্ষতির টাকা গত আট বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো এখনো তা দেয়নি।

তাছাড়া বিগত ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ১৯টি ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে। এসময় মোট ঋণ নিয়েছে ১৩ হাজার ৪২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পরিশোধ করেছে ১২ হাজার ১৯৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এহিসেবে বয়েকা রয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪২১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ৮টি ব্যাংকে গ্রুপটির কোনো ঋণ নেই।


উপরে উল্লেখিত ফিরিস্তি হতে প্রতীয়মান হয় যে, দেশবন্ধু গ্রুপ পর্যাপ্ত পরিমাণ লোনের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করেছে। এর প্রমাণস্বরূপ ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে দেশবন্ধু গ্রুপকে প্রশংসাপত্রও দেওয়া হয়েছে।  কিন্তু অতি সম্প্রতি একটি স্বার্থান্বেষী মহল গ্রুপটিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এমনকি দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে সরকারকেও বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ব্যাংকার-কাস্টমার সম্পর্ককেও অবনতি ঘটাতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য তারা গ্রুপের গোপনীয় তথ্য অনৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিতভাবে বিভিন্ন মহলের কাছে সরবরাহ করছে। তাছাড়া বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে গ্রুপটি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। 


এতদসত্ত্বেও, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ সম্প্রতি এলসি না দেওয়া সত্ত্বেও দেশবন্ধু গ্রুপ ব্যাংকগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণের টাকা পরিশোধ করেছে। এলসি না দেওয়ার কারণে, কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানাগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যক্তি সম্পদের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলো এলসি খোলা নিয়ে তালবাহানা করছে।

শুধু এলসি বন্ধ করেই ক্ষান্ত থাকেনি ব্যাংকগুলো, উল্টো ব্যাংক ও কাস্টমার সম্পর্কের গোপনীয় তথ্য ভুলভাবে সরবরাহ করে দেশবন্ধু গ্রুপের ইমেজ সংকট তৈরি করছে। এতে করে পুরো বিষয়টি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের এরকম একটি শিল্পগ্রুপ তৈরি হতে লাগে অনেক মেধা, পরিশ্রম, সময় ও অর্থ; যা দেশের সম্পদ।


ব্যাংকগুলো নিজেদের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের অযাচিত সত্য-মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে গ্রুপটিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় বিষয় বলে মনে করছেন সংশিষ্টরা। 


এদিকে ঋণপত্র (এলসি) না খোলার কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়া এবং সিআইবি তালিকাসংক্রান্ত হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) পরিচালক বরাবর ৬ জানুয়ারি পৃথক দুটি চিঠি দিয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ।

চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশবন্ধু গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ হিসেবে বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক আমাদের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণপত্র খুলতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। ব্যাংকসমূহের দাবি, দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডের নাম সিআইবি শ্রেণিকরণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকায় তারা দেশবন্ধু গ্রুপের অধীন বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণপত্র খুলতে পারছে না।

 
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী মহোদয়ের আদালত গত ২৬ নভেম্বর এক মামলায় নিম্নলিখিত আদেশ প্রদান করেছেন: 


নিম্নে উল্লিখিত আপিলকারী  দেশবন্ধু সুগার মিলসসহ গ্রুপের অন্য ২০টি কোম্পানির ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্টের প্রকাশ, অন্তর্ভুক্তি এবং শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত বিষয়ে আগামী তিন (৩) মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হলো। 


উল্লেখ্য, গত ৮ ডিসেম্বর দেশবন্ধু গ্রুপ আদালতের আদেশের প্রত্যয়িত অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকে যথাযথভাবে দাখিল করে। অনতিবিলম্বে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ডিএমএসএল-এর কারণে দেশবন্ধু গ্রুপের অধীন কোম্পানিগুলোর নাম সিআইবি তালিকায় সংশোধন/ অপসারণ করে দেশবন্ধু গ্রুপের স্বার্থ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহকে দেশবন্ধু গ্রুপের অধীন কোম্পানিগুলোর পক্ষে ঋণপত্র খোলার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 
এ বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রুপ সিএফও বশির আহমেদ জানান, দেশবন্ধু গ্রুপ দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপের মধ্যে একটি স্বনামধন্য শিল্পগ্রুপ। দেশবন্ধু গ্রুপ ব্যবসা শুরু করে ১৯৮৯ সালে বাল্ক কমোডিটি ট্রেডার হিসেবে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ আমদানিযোগ্য পণ্য তখন থেকেই আমদানি করে দেশের বাজারে সরবরাহ করছে। এরপর সরকারের মালিকানাধীন চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছ থেকে ২০০২ সালে সুগার মিলের মালিকানাস্বত্ব লাভ করে। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশবন্ধু সুগার মিলটি প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডারের মাধ্যমে মিলটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে ২০০৫ সালে।

২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভালোভাবে ব্যবসা করে আসছিল মিলটি। তখন দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক দেশবন্ধু সুগার মিলের ভালো প্রশংসা করছিল। এ মর্মে কোম্পানিটির কাছে কয়েকটি ব্যাংকের প্রশংসাপত্র রয়েছে। ২০১০ সালের পর ২০১১ সালে তৎকালীন সরকার কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডেকে উচ্চমূল্যেও সুগার আমদানি করতে বাধ্য করে। যার ফলে দেশবন্ধু সুগার মিলের ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।

অর্থাৎ, যখন দেশবন্ধু সুগারের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা, তখন এক আমদানিতেই কোম্পানির ৩৭৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সব অথরিটির কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, সরকারের কথা অনুযায়ী দেশবন্ধু সুগার মিলসের সুগার আমদানি করে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো কোম্পানির ক্ষতি হলে বিষয়টি সরকার দেখবে।

সরকারের কথা অনুযায়ী তখন কোম্পানির ক্ষতির ৩৭৮ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে আবেদন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অদ্যাবধি ক্ষতির সে টাকাটা ফেরত পাইনি কোম্পানিটি। ফলে ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতির কারণে এবং এই টাকাটি না দেওয়ার কারণে আমাদের ব্যবসায় চলতি মূলধন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পরক্ষণে ২০১৩-১৪ সাল হতেই ব্যাংকগুলো উচ্চ হারে সুদ চার্জ করতে থাকে। এক সময় ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করতে থাকে; যা গ্রুপের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই ৩৭৮ কোটি টাকার উপরে ১৮ শতাংশ হারে সুদ চার্জ হতে হতে এবং সঞ্চিত হতে হতে দেশবন্ধু সুগারের ব্যবসা অনেক কমে যায়। 


তিনি আরো বলেন, ব্যাংকগুলো দেশবন্ধু গ্রুপের কাছে ঋণের কিছু টাকা পাবে এটি সত্য এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধও করা হচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এই মহাসংকটময় কালে ঋণ পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। যার কবলে শুধু দেশবন্ধু গ্রুপই পড়েনি, বরং দেশের সব ধরনের কোম্পানি সাফার করছে। বশির আহমেদ আরো বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপের মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান একদিনে প্রতিষ্ঠা হয়নি। এটি দেশের অনেক বড় সম্পদ। বিগত দিনে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের অনুকূলে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করেছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো শিল্পগ্রুপকে নতুন করে চলতি মূলধন হিসাবে অর্থের জোগানও দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলো দেশ স্বাধীনের পর থেকে অদ্যাবধি কোটি কোটি টাকা লোকসানের পরও ভর্তুকি দিয়ে কর্মসংস্থান ঠিক রেখেছে। দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের স্বার্থে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেশে ও বিদেশের মানদণ্ড ঠিক রেখে এই বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার একটি দিকনির্দেশনা দিতে পারে বলে জানান তিনি।

শিহাব

×