ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ায় কমছে বিক্রি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ায় কমছে বিক্রি

.

হঠাৎ করেই অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে  বেশকিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি (এসডি) বাড়িয়ে দেওয়ায় বাজারে এ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে যে-সব প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্ট অর্থাৎ আগে থেকেই নিয়ম মেনে ভ্যাট আদায় করে আসছিল, তারা বর্ধিত ভ্যাট আদায় শুরু করেছে। ব্র্যান্ডেড পোশাকের আউটলেটগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মোবাইল ফোন টকটাইম ও ইন্টারনেটেও বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। সব ধরনের সিগারেটের খুচরা পর্যায়ে প্রতি স্টিকে দাম বেড়েছে দুই টাকা। সিগারেট বিক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা খরচ বাঁচাতে কম দামি সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন। 
এর আগে মঙ্গলবার রাজধানীর প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসার আহ্বান জানান ব্যবসায়ীরা। অতীতে ভ্যাট ইস্যুতে সরব ছিল পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এবারও তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী সংগঠনের একজন সদস্য ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আমির হোসেইন নূরানী বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি তুলে ধরেছি। আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিষ্ঠানের চাবি জমা দিয়ে আসতে চাই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন বা আন্দোলনে নামবেন। ঢালাওভাবে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের ব্যবসায়ীদের নেতাদের একটি অংশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেছেন। তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারকে আহ্বান জানান। তারা সম্প্রতি ‘দ্য অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন রিফর্ম কাউন্সিল’-এর ব্যানারে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) কাছে এ দাবি জানান।
পরিষদের আহ্বায়ক জাকির হোসেন নয়ন বলেন, পরিষদ সরকারের কাছে অবিলম্বে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনার দাবি জানায়, কারণ এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত জুলাই বিপ্লবের চেতনার পরিপন্থি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’ ভ্যাট বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী হিসেবে উল্লেখ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিও। এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। গত ১৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে এফআইসিসিআই বলেছে, ভ্যাট, এসডি ও অন্যান্য ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে ব্যবসায় খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে যার প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়বে। এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসার কার্যক্ষম ক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
ভ্যাট ও এসডি-এর কারণে দাম বৃদ্ধি ॥ গত জুনে বেশকিছু পণ্য ও সেবার ভ্যাট এবং এসডি বাড়ানোর মাত্র সাত মাসের মাথায় এসে সম্প্রতি প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর নতুন করে ভ্যাট ও এসডি বাড়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর থেকেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে শুরু করেছে। তবে কিছু পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে এই প্রভাব বোঝার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর কল্যাণপুর, কাওরান বাজার, হাতিরপুল এলাকার প্রায় ১০ জন খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপেল, মালটা, কমলা, নাশপাতির দাম কেজি প্রতি ২৫-৩০ টাকা বেড়েছে। আর আনারের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, নিম্নবিত্ত পরিবার এ ফল বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কিনত না,  আর এখন  দাম বাড়ার ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। কল্যাণপুরের ফল বিক্রেতা হজরত আলি বলেন, ‘আগে ১,০০০ টাকায় যে ফল কিনতে পারতাম এখন সেই ফল কিনতে হয় ১,৩০০ টাকায়। ৩ দিন আগে প্রতি কেজি মালটা কিনেছি ২৮০ টাকা এখন কিনতে হয়েছে ৩০০ টাকা।’
কল্যাণপুরে আরেক বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম তাওহিদ বলেন, আমাদের বিক্রি এখন ২০ শতাংশ কমে গেছে। যারা উচ্চবিত্ত তাদের তো কিনতে সমস্যা নেই। আর নিম্নবিত্তরা তো এ ফল কিনেই না। এখন মধ্যবিত্তরাও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। আগে যিনি দুই প্রকার ফল দুই কেজি কিনতেন, এখন তিনি এক কেজি কিনছেন দুই প্রকার ফল মিলিয়ে। কেউ আবার একটা আনার কিনছেন, ৩টি কমলা কিনছেন’। মোসারফ হোসেন (৬৫) নামে এক ব্যক্তি গ্রাম থেকে ঢাকায় ছেলের বাসায় এসেছেন চিকিৎসার জন্য।  কল্যাণপুর থেকে ফল কিনেছেন তার নাতির জন্য। জানতে চাইলে বলেন, ৩টি কমলা ও দুইটি ছোট আনার কিনেছেন। ওজনে এর দাম এসেছে প্রায় ৩৫০ টাকা। তিনি বলেন, দুই বছরের ছোট শিশু  কমলা ও আনার পছন্দ করে  কিন্তু এত দাম তাই বেশি নিতে পারিনি।’  চশমার ফ্রেম ও গ্লাসের ভ্যাট তিনগুণ বেড়ে ১৫ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
রাজধানীর মৌচাকের চশমা বিক্রেতা এনামুল কবির বলেন,  প্লাস্টিক ফ্রেম যেটা কেনা দাম ছিল ১০০ টাকা সেটা এখন ১৩০ টাকা হয়েছে। আর মেটাল ফ্রেম যেটা ২২০ টাকা ছিল সেটা এখন ২৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরায় সেফ ট্রেডিং নামে একটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মুড়ির মোয়া, নাড়ু, নারকেলের নাড়ুসহ খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য  তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমার প্রতিদিন ৩৫ কেজির একটি সিলিন্ডার গ্যাস প্রয়োজন হয়। আগে এটা চার হাজার ২০০ টাকায় কিনতাম এখন এর দাম হয়েছে চার হাজার ৬০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, এছাড়া যত প্রকার কাঁচামাল আছে তার দাম বাড়বে। 

×