ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১

প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রি এখন শূন্যের কোটায়

ড্যাপ নিয়ে সংকটে আবাসন খাত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

ড্যাপ নিয়ে সংকটে আবাসন খাত

বর্তমানে আবাসন শিল্পে যে সংকট

বর্তমানে আবাসন শিল্পে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার মূলে রয়েছে ‘ড্যাপ’ এর  হ্রাসকৃত  ফ্লোর এরিয়া রেশিও ‘ফার’। এটি শুধু আবাসন ব্যবসায়ী না, জমির মালিক ও আবাসন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লিংকেজ শিল্পের জন্যও মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্মাণ কাজে স্থবিরতা, প্লট আর ফ্ল্যাট বিক্রি এখন শূন্যের কোটায়। ক্রেতাদের কিস্তি পরিশোধও বন্ধ। নেই টাকার সরবরাহ।

ফলে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার হুমকিতে পড়ায় ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। এ ছাড়াও আবাসন কোম্পানিগুলোতে ২০ হাজার নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপক, ১০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, তিন হাজার স্নাতক প্রকৌশলী এবং প্রায় ৫০০ স্থপতি নিয়োজিত আছেন। সরাসরি অর্ধকোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে আবাসন শিল্পে। আর এই শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রায় দুই কোটি মানুষ নির্ভরশীল।
বিগত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি স্থানীয় হোটেলে ড্যাপ নিয়ে সভা হয়, সেখানে তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ অনেক  নেতৃবৃন্দ সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সভাতেই মূলত ঢাকা বাসীর ওপর ড্যাপ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ২০২২ সালের আগস্ট মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলে তারপর থেকেই ঢাকার জমির মালিকরা ফ্ল্যাট তৈরিতে  বৈষম্যের মধ্যে পড়েন। গত ২ বছর ধরে নকশা অনুমোদন কমে যায় এবং আবাসন খাতে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ রাজউক কর্মকর্তার পোয়া বারো অবস্থা হয়, কারণ কারসাজির মাধ্যমে আগের নিয়ম অনুযায়ী নকশা অনুমোদন করে দিচ্ছে তারা।  
এদিকে, সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক এবং আবাসন ব্যবসায়ীরা মন্ত্রণালয় ও রাজউকে ড্যাপের বিধিমালা সংশোধনের জন্য আবেদন করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে কয়েক দিন আগে ড্যাপ সংশোধনের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ মালা পাঠিয়েছে।

এ বিষয়ে রাজউক  চেয়ারম্যান (অব.) মেজর জেনারেল ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (নাম) বলেন, আমি রিহ্যাব ফেয়ারে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সেই মোতাবেক রাজউক থেকে মন্ত্রণালয়ে ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এখন মন্ত্রণালয়ে সেটা যাচাই বাছাই হচ্ছে। আশা করি খুব শীঘ্রই ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে সরকার। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ড্যাপের বর্তমান সুপারিশ এ ১৬ ফিট রাস্তার নিচে যারা বাড়ি বানাবে তাদের জন্য কোনো সুখবর নেই।

তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশ সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক সমিতির সমন্বয়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম.এ সাজ্জাদ বলেন, আমরা ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ মানুষ চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। ২০০৮ এর বিধি অনুসারে রাস্তা অনুযায়ী যেখানে যত তলা ভবন পাওয়া যেত,  সেখানে তত তলা অনুমোদন দিতে হবে। সকল বৈষম্য অপসারণ করে নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী সংশোধিত বিধিমালা প্রণয়ন করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।

রাজউক থেকে ভবন নির্মাণ অনুমোদন সহজীকরণসহ যাবতীয় হয়রানি বন্ধ করতে হবে। রাজউকের প্রতিটি অনুমোদেনের জায়গায় পদে পদে হেনস্থা করা হয়। ঘুষ ছাড়া সেখানে কোনো কাজই হয় না। মাসের পর মাস সেখানে  ঘোরানো হয়। রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কুকীর্তি থেকে ফিরে আসতে হবে এবং এমন কাজ যেন  আগামীতে না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা বিগত ৫ মাস ধরে কোনো ইমারত বানাতে পারছি না।

রাজউকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী  ঘুষ নিয়ে আগের নিয়মে নকশা পাস করাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে রাজউক  চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসেছিলাম। আমাদের দাবি যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) প্রেসিডেন্ট আর্কিটেক্ট ড. আবু সাইদ মোস্তাক আহমেদ বলেন, ড্যাপ স্থগিত করে পরবর্তীতে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।

ড্যাপ সংশোধনে সকল পক্ষের মতামত গ্রহণ, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তাদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কক্সবাজারে ড্যাপ করতে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার, সেখানে ঢাকার ড্যাপের জন্য খরচ হয়েছে ২২ কোটি টাকা। এটা জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে রাজউকের ভিশনটা ভালো। এ নগর বাঁচাতে ড্যাপ করতে হবে। তবে ভূমি মালিকরাও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হউন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। 
বিদ্যমান ড্যাপে রাজউক আরও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। এ ব্যাপারে রিহ্যাব এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জি. আব্দুল লতিফ বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় করা বৈষম্যমূলক ডিটেল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নে কারসাজি শুরু হয়েছে। ঢাকা শহরের ভূমি মালিক এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবিকে উপেক্ষা করে ড্যাপ সংশোধনে গড়িমসি করা হচ্ছে।

আটকে আছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। অথচ ২০ হাজার প্ল্যান জমা দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। কতিপয় মহলের ইন্ধনে ড্যাপ বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছে তারা ফ্যাসিবাদ সরকারের দোসররা এখনো রাজউকে সক্রিয়। এরাই নানা ধরনের সেবার নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণেই ড্যাপ সংশোধন হচ্ছে না। বিভিন্ন কৌশলে আগের ড্যাপ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অপরদিকে রিহ্যাব পরিচালক ইঞ্জি মঞ্জুরুল ফরহাদ (ফিলিপ) বলেন, ড্যাপ সংশোধন করে ২০০৮ এর বিধিমালার ন্যায় করতে হবে। সংশোধন না করা হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাজউক যদি খামখেয়ালি ভাবে ড্যাপের সংশোধনের সুপারিশ করে থাকে তবে দুর্বার আন্দোলন করা হবে। জানা যাচ্ছে, তৎকালীন সরকারের প্রেতাত্মারা ড্যাপকে (২০২০-২০৩৫) বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। 
এর ফলে শুধু কৃষি জমিই ধ্বংস হচ্ছে না ঢাকাবাসীর বসবাস করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। 
ফ্ল্যাটের দাম অনেক  বেড়েছে। ধানমন্ডি- গুলশান-বনানী অভিযাত এলাকা ছাড়া অধিকাংশ এলাকায় অনেক জমির মালিক এবং ঢাকাবাসী বৈষম্যের শিকার হয়েছে। প্রজ্ঞাপন করা ড্যাপ বলবত করার মানে গত ৫ মাস ধরে রাজউক যে আশ্বাস  দিয়েছিল তা প্রতিশ্রুতি ভঙের শামিল হবে।

×