পরিবার থেকে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র থেকে বিশ্ব- সবকিছুর চালিকাশক্তি হলো অর্থনীতি। শক্তিশালী অর্থনীতি বিশ্বের কাঠামোকে শক্তিশালী করতে পারে। যদিও অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা বলতে কিছু নেই। খুব কম সময়ই এই স্থিতিশীলতা থাকে। তবে একটি সরলরৈখিক কাঠামো ধরে রাখা যায় যদি সেই দেশ অর্থনীতির ব্যাকরণগুলো মেনে চলতে সক্ষম হয়। গত কয়েক বছর ধরেই বৈশ্বিক অর্থনীতি কোমায় যাওয়া শুরু করে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে। তারপর যুদ্ধ, পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন, উৎপাদনে ঘাটতি প্রভৃতি কারণে অর্থনীতি দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবারও আগের অবস্থায় পৌঁছে। তবে গত বছর অনেক দেশই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। জীবনযাত্রা আবারও আগের মতো চলতে শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে। আবার শ্রীলঙ্কা এর উল্টা। সর্বকালের কম মূল্যস্ফীতিতে পৌঁছেছে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী ২০২৫ সালের অর্থনীতি যে খুব ভালো যাবে না তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল যুদ্ধ দিয়ে এবং শেষও হয়েছে যুদ্ধ দিয়েই। এখনো রাশিয়া-ইউক্রেন জ্বলছে। ইসরাইল তার সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর অর্থনীতি, রাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইলের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান, মধ্যপ্রাচ্য উত্তেজনা, লোহিত সাগরে উত্তেজনা, পরমাণু সংকট, তাইওয়ান ইস্যু প্রভৃতি কারণে ভূরাজনীতি এখন গোলমেলে অবস্থানে রয়েছে ঠিকই। এরই মধ্যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। উত্তরণের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল করোনার পর থেকে। সদ্যসমাপ্ত বছরটি ছিল সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং। দ্য মাস্টারকার্ড ইকোনমিকস ইনস্টিটিউট (এমইআই) পূর্বাভাস দিয়েছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২০২৪ সালে ৩ দশমিক ১ শতাংশ হলেও ২০২৫ সালে তা ৩ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হবে। মাস্টারকার্ডের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভিড ম্যান বলেছেন, ‘আমরা যদি ২০২৪ সালকে স্বাভাবিকতায় ফেরার বছর হিসেবে ধরি, তাহলে ২০২৫ হচ্ছে স্থিতিশীলতার বছর। আর্থিক নীতিতে শিথিলতা আছে, প্রতিকূলতা কমছে; এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে ভোক্তারা উপকৃত হবে।’ অর্থনীতি কতটা চাপে আছে সেটা বোঝা যায় কয়েকটা বিষয় লক্ষ্য করলে। প্রথমত, বাজার এবং দ্বিতীয়ত, বেকারত্ব। যদি বাজারে নিত্যপণ্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকে তাহলে বোঝা যায় সেই দেশের অর্থনীতি চাপ থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হয়েছে। আর বেকারত্ব যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায় তা হলে হয় রিজার্ভও শক্তিশালী এবং অর্থনীতিও পায় গতি। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রেমিটেন্স আসায় গতি পেয়েছে। ফলে রিজার্ভও আগের থেকে ভালো অবস্থানে ফিরছে। যদিও বাজার মূল্যস্ফীতি চোখ রাঙাচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হবে। এতে অনেক রকম বাণিজ্যিক সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন একদিকে যেমন বাংলাদেশের ঋণমান বাড়বে; ঠিক তেমন বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তি সঙ্কুচি হয়ে আসবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের সুদও বাড়বে নিয়ম মোতাবেক। অনেক বাজারে হয়তো এখনকার মতো সহজ শুল্কমুক্ত সুবিধাও থাকবে না, যদিও ২০২৬ সালের পরের তিন বছর পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধাগুলো বহাল রাখার চেষ্টায় আছে বাংলাদেশ। তা না হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আইএমএফও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাসের খবর দিয়েছিল গত এপ্রিলে। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এপ্রিল সংস্করণ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করবে। একই সঙ্গে কমতে শুরু করবে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও অবদান বাড়বে বাংলাদেশের। ২০২৮ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১৯তম। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক জিডিপির শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আগামী পাঁচ বছরে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ পয়েন্ট প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হয়েছে। এর ফলে ২০২৮ সালে বিশ্ব জিডিপিতে বাংলাদেশ ১ দশমিক ০১ শতাংশ অবদান রাখবে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে খুব নিশ্চিন্ত হওয়ার কারণও নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মসনদে বসার পর চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে এটা ঘটার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি, তবে তা হবে বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্যও ভয়াবহ। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলো বড় ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে বৈশ্বিক জিডিপির বড় ধরনের সঙ্কোচন হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অর্থনীতির এই সঙ্কোচনের পরিমাণ ইউরোপের বড় দুই দেশ ফ্রান্স ও জার্মানির সম্মিলিত জিডিপির সমান হতে পারে। আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথ বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য পরিকল্পনার প্রভাব কী হবে, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলে বা বড় পরিসরে শুল্ক আরোপ করা হলে বিশ্ব জিডিপি প্রায় ৭ শতাংশ সঙ্কুচিত হতে পারে। বিশ্বের দুশ্চিন্তার কারণ মধ্যপ্রাচ্যও।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলের সরবরাহ যুদ্ধ বা অন্য অস্থিরতার কারণে বাধাগ্রস্ত হলে বিশ্ব জ্বালানি তেল সংকটে পড়তে পারে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি দুর্বল হলেও বিশ্বের ক্ষতি। কারণ বৈশ্বিক জিডিপিতে বড় অবদান রাখছে মধ্যপ্রাচ্য। বলা যায় বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য সামনে আসছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের ফলে ইরান দুর্বল হয়েছে। সেই সঙ্গে রাশিয়াও। কারণ আসাদ সরকারকে সহায়তা করছিল রাশিয়া। তাকে আশ্রয়ও দিয়েছে দেশটি। অর্থাৎ এখানে পরাশক্তিগুলোর দ্বৈরথ স্পষ্ট। এসব দ্বৈরতের চাপে থাকে অর্থনীতি। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা সুখবরের আভাস থাকলেও রয়েছে দুশ্চিন্তাও।
বিশ্ব অর্থনীতি এবং বাংলাদেশ
শীর্ষ সংবাদ: