নতুন বছরেও রাজধানীতে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য ক্রয়ের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সরকার পণ্যমূল্যের রাশ টেনে ধরতে কী ব্যবস্থা নেয়, সেদিকে তাকিয়ে আছেন অনেকেই। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। দেশকে ‘উন্নয়নে বিশ্বের রোল মডেল’ হিসেবে দেখানোর যে বয়ান ছিল, তা যে অনেকটাই ফাঁপা, সেটা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, অন্যদিকে চাকরির যথেষ্ট সুযোগ নেই। দেড় দশক ধরে চলা অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ফলে নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না।
বিদায়ী বছরটি শুরু হয়েছিল সংকটের মধ্যে, তবে আশাবাদও ছিল। কিন্তু যাদের অলিগার্ক বলে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা, সেই সংকট আর চাপ থেকে বের হতে পারেনি অর্থনীতি।
ব্যাংক দখল, অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি তোষণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস, প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে অর্থ লোপাট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছিল। অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাঁধে এখন দায়িত্ব অর্থনীতির ক্ষত সারানো।
দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে যে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের সারমর্ম হচ্ছে, দেশে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যারা দেড় দশক ধরে লুটপাট করেছে। কমিটির হিসাবে এ সময় কেবল বিদেশেই পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ লাখ কোটি টাকা। অর্থ পাচার অনেকটা অর্থনীতির রক্তক্ষরণের মতো।
বে ২০২৫ সালেই এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে-এমন নিশ্চয়তা নেই। সরকারের অবশ্য বড় কাজ হবে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা করা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে সাধারণ মানুষ। তারা স্বস্তি চায়। তরুণ প্রজন্মেও জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সে জন্য দরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। দ্রুত ঠিক করতে হবে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অর্থনীতির যেসব সংকট নিয়ে দেশ নতুন বছরে পা রেখেছে, সেগুলো নতুন নয়। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, ব্যাংক লুটপাট-এসব নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। অন্তর্র্বতী সরকার ইতোমধ্যে কিছু পচন ঠেকাতে সফল হয়েছে, কিন্তু লুটপাটের জের শিগগির মিলিয়ে যাচ্ছে না। নতুন বছরে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।
কারণ, লুকিয়ে রাখা মন্দ ঋণ প্রকাশ্য হবে। ডলারের দাম কোথায় স্থির হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। আর মূল্যস্ফীতিতে দ্রুত লাগাম টানা যাবে-এমন আশা কম। এক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিষণ্ন চিত্রই এঁকেছে। সরকারের ঋণমানের অবনমন করে মুডিস বলেছে, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অন্তত তিনটি সমস্যা তৈরি হতে পারে। এগুলো হলো কম রাজস্ব আয়, বহিস্থ খাতের দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতসংক্রান্ত ঝুঁকি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা হলেও আশাবাদী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
প্রবৃদ্ধির উত্থান আর মূল্যস্ফীতি পতনের এই বহুল প্রত্যাশিত ঘটনা আগামী বছর থেকেই শুরু হতে পারে। তবে আমূল সংস্কার না করতে পারলে নতুন বছরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। নানা রকম দাবি-দাওয়ার মধ্যে দেশ যখন ‘বায়নাঘর’ হয়ে উঠেছে, তখন সরকার পরিচালনার খরচ বেড়ে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। তাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে সরকারকে ঋণের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে হবে।
নতুন বছরে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকার বদলের পর বন্ধ হয়েছে এমন কিছু কলকারখানা, যেগুলোর মালিক আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গত জুন শেষে দেশে ২৬ লাখ ৪০ হাজার কর্মক্ষম মানুষ বেকার ছিলেন। কাজ হারিয়ে তাঁদের সঙ্গে নতুন বেকার যোগ হলে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কেবল খারাপই হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করতে না পারলে অথবা বিদেশী বিনিয়োগ না আনতে পারলে তরুণদের জন্য চাকরি দূরের স্বপ্ন হয়েই থাকবে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার সাফল্যের মুকুটে আপাতত একটিই পালক-রিজার্ভ পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করেই বেশিরভাগ বিদেশী দায় পরিশোধ করা হয়েছে, পাশাপাশি রিজার্ভও বেড়েছে। ডলারের দামেও মোটামুটি স্থিতিশীলতা এসেছে। একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মধ্যে বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদও আছে। ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থনীতি হয়তো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে না, তবে প্রবৃদ্ধির ধারায় অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি এ বছরই শুরু করতে হবে।
আর সে জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে। নতুন বছরের শুরুতেই হঠাৎ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁরা মতে, কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্তর্র্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে কিংবা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে সরল রাস্তার সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
এতে নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ আরও বাড়বে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে তৈরি পোশাক, এসি, রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে।’ বাস্তবতা হলো যেসব পণ্যের ওপর কর কমানো বা শূন্য করা হয়েছে, সেসব পণ্যের দামও তো তেমন কমেনি। জনজীবনের কথা চিন্তা না করে যদি শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য ভ্যাট বাড়ানো হয়ে থাকে, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। সরকারের উচিত ধনীদের ওপর আরও বেশি কর আরোপ করে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া। এমনকি কর ব্যবস্থাপনায় যেসব ত্রুটি ও দুর্বলতা আছে, সেগুলো দূর করলেও রাজস্ব অনেক বাড়বে।
বিগত সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে অনেক অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য দেড় কোটি টাকার গাড়ি কিনেছে, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা করে ভাতা দিয়েছে।
পূর্ববর্তী সরকার যখন এসব অনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল, তখন বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এখন তাঁরা সেই নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন।
প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার ঘাটতি মেটাতে পারে। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হোক।
আর্থিক প্রবাহের গতি-প্রকৃতি
শীর্ষ সংবাদ: