![শিল্প খাতে গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়ানো হবে আত্মঘাতী শিল্প খাতে গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়ানো হবে আত্মঘাতী](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/fn-7-2501081645.jpg)
শিল্প খাতে গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়ানো হবে
নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিনগুণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। এরপর গত বছর ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটে আরও ৭৫ পয়সা দাম বাড়ানো হয়।
তবে দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। এ অবস্থায় সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে আবারও গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়াতে চায় সরকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাবনায় প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা শুধু নতুন শিল্পকারখানার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। পুরাতনদের ছাড় দেওয়া হবে মূল্যে।
যে প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে দেশের চলমান শিল্পোন্নয়ন থমকে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, এরই মধ্যে শিল্পকারখানা ও ক্যাপটিভের নতুন সংযোগে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। দর নির্ধারিত না করে আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যত পড়বে সেই দর আদায় করতে চায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
পুরাতন শিল্প কারখানায় লোড বাড়াতে চাইলেও গুনতে হবে দ্বিগুণ মূল্য। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে, আর কমে গেলে কমবে। দুই ধরনের দর প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদিত (প্রতিশ্রুত) কিন্তু সংযোগ চালু হয়নি এমন গ্রাহকদের এক রকম দর, আর নতুন শিল্পে ভিন্ন দর নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকের অর্ধেক গ্যাসের দর হবে বিদ্যমান দরের সমান, আর অর্ধেকের জন্য আমদানি মূল্য।
এই প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে বিইআরসির কাছে পৌঁছেছে। আমলেও নিয়েছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. জালাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, গত ৬ জানুয়ারি শিল্পকারখানার বয়লার ও শিল্পকারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। প্রস্তাবে বিদ্যমান গ্রাহকদের দর অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে। বিইআরসি মূল্যায়ন কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর গণশুনানি গ্রহণের পর আদেশ দেবে।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির (জিটুজি) আওতায় এবং স্পর্ট মার্কেট থেকে (উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে) এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। জিটুজি চুক্তিতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, যে কারণে ওই দর প্রকাশ করা হয় না। তবে গত আগস্ট মাসে স্পর্ট মার্কেটের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়েছে ৭১ টাকা।
প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুমোদিত হলে প্রতিশ্রুত গ্রাহককে তার ব্যবহৃত অর্ধেক গ্যাসের জন্য ঘনমিটার প্রতি প্রায় ৬০ টাকার মতো পড়তে পারে। অর্ধেকের জন্য বিদ্যমান দর ৩০ টাকা হারে দিতে হবে। নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ৬০ টাকা হারে বিল দিতে হবে।
এ সিদ্ধান্তটি শিল্প খাতের জন্য দ্বিচারিতামূলক হলো কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মো. ফাওজুল কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি খাতে আমাদের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা নানান পদক্ষেপ নিচ্ছি। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা গত ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের সভায় নীতিগত অনুমোদন পায়।
শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে সম্ভাব্য নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে পরিশোধ করবেন। শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে প্রতিশ্রুত (প্রাথমিক সম্মতিপত্র/চহিদাপত্র ইস্যুকৃত) গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকগণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যমান শিল্প/ক্যাপটিভ পাওয়ার শ্রেণির মূল্যে প্রাপ্য হবেন। অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে দাম পরিশোধ করবেন।
একইসঙ্গে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহক অনুমোদিত লোড অপেক্ষা অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে দাম পরিশোধ করবেন। তবে যেহেতু দাম বাড়ানো কমানোর ক্ষমতা আমাদের হাতে নাই তাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে বিইআরসি।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার। দেশীয় এসব উৎস থেকে দৈনিক কমবেশি ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।
এলএনজি আমদানি থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৪.৩৮ টাকা। আর গ্যাসের গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ২২.৮৭ টাকা। এতে করে প্রতি ঘনমিটারে ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছিল ৬৫ টাকা, যা আগস্টে (২০২৪) ৭১ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে (সরকারি ও আইপিপি) ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪.৭৫ টাকা ঘনমিটার এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০.৭৫ টাকা ঘনমিটার করা হয়। তার আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছিল। আর ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল।
এখন এক লাফে আড়াইগুণ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবকে আত্মঘাতী বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বুধবার ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্প উদ্যোক্তারা কারখানা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। তাহলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আর বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে পার্থক্য কী থাকল?
একই রকমভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৭০-৭৫ টাকা কেন করা হবে? এতবড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কেন আলোচনা করা হলো না?
তবে ব্যবসায়ীরা সম্মতি দিয়েছেন বলেই জানিয়েছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে লিখিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর এরপরই আগানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন শিল্পকারখানার মালিকরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হলে কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চান তারা এ সিদ্ধান্ত মেনেই আসবেন।
নতুন দামের সঙ্গে নিজেদের সম্মত করেই বিনিয়োগ করবেন। তাই এ বিষয়ে কোনো ঝামেলা হবে বলে মনে হয় না। যারা পুরাতন তারা তো সুবিধা পাচ্ছেই। নতুনদের তো আর ভর্তুকি দিয়ে সংযোগ দেওয়া যায় না। তাদের এই নিয়ম মেনেই বিনিয়োগে আসতে হবে।
তবে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তটি সরকারের জন্য সুখকর নয় বলে মন্তব্য করেছেন খোদ বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। বুধবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তটি সরকারের জন্য সুখকর নয়। তারপরও করতে হবে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে।
দেশজুড়ে যখন নানা খাতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, এটা তো পেট্রোবাংলার একটি প্রস্তাবনা। এখনো দাম বাড়েনি।
যাচাই-বাছাই শেষে দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। তবে যদি দাম বাড়ে এক্ষেত্রে যেসব কারখানা এই দামে গ্যাস নিতে পারবে তারাই নেবে। তবে এক্ষেত্রে একটা অসম প্রতিযোগিতা হবে। এরা স্থানীয় বাজারে যেমন প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। দাম যদি বাড়ে তাহলেই বাজারে এর কি প্রভাব পড়বে না পড়বে এ বিষয়ে বলা যাবে।
তবে দাম বাড়লেও গ্যাসের সরবরাহ তেমন বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন না কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে দিন দিন। নতুন কূপগুলোতে গ্যাস পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা এখনি দেখা যাচ্ছে না। টার্মিনাল সক্ষমতা না থাকায় এলএনজি থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। তাই গ্যাস দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সুখকর হবে বলে আমার মনে হয় না।