![পদোন্নতি ছাড়া এক পদে ১৪ বছর কর্মকর্তারা পদোন্নতি ছাড়া এক পদে ১৪ বছর কর্মকর্তারা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/b5-2501051727.jpg)
২০১০ সালে নিয়োগের পর গত ১৪ বছরে একটিও পদোন্নতি জোটেনি
২০১০ সালে নিয়োগের পর গত ১৪ বছরে একটিও পদোন্নতি জোটেনি। এটি কেবল কোনো ব্যক্তির নয়, পুরো বিভাগের সকলেই এমন পদোন্নতিবঞ্চিত। অথচ অন্য বিভাগের কয়েক বছর পরে যোগ দেওয়া জুনিয়ররাও এখন সিনিয়র হয়েছে। বৈষম্য নিরসনে করতে গিয়ে যেখানে দেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এমন পদোন্নতি বৈষম্য কারও নজর কাড়ছে না বলে আক্ষেপ বঞ্চিতদের। এদিকে সমস্যা নিরসনে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পদবঞ্চিতদের নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও তা এখনো পর্যন্ত শুধুই স্বান্তনার বাণী এমনই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
তথ্যপ্রযুক্তি চালুর মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সহজসাধ্য করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাখাগুলোকে ম্যানুয়েল পদ্ধতির ব্যাংকিং প্রথার পরিবর্তে ইন্টারনেট নির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য একের পর এক সফটওয়্যার তৈরি, সমগ্র ব্যাংকের আইটি অবকাঠামো নির্মাণ, ডাটা সেন্টার প্রতিষ্ঠা, ডাটাবেজ ব্যবস্থাপনাসহ আইটি’র নানাবিধ কর্মকা- এই বিভাগের কর্মকর্তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে।
শহর-গ্রাম নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণকে ঘরে বসে ব্যাংকিং সেবা পেতে আইটি বিভাগের তৈরি একাধিক মোবাইল অ্যাপস (ব-ডধষষবঃ, ব-ঝযবনধ) ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এছাড়াও, ফরেন রেমিটেন্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ইঅঞঈঐ, ঈওই, ঐজগঝ প্রভৃতিসহ নিত্য ব্যবহার্য অর্ধ-শতাধিক সফটওয়্যার তাদেরই তৈরি। দেশের সর্ববৃহৎ এ বাণিজ্যিক ব্যাংকের আইটি বহির্ভূত অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইটি ভীতি দূর করে আইটির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, সাইবার সচেতন করা, আইটি বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি প্রভৃতি আইটি কর্মকর্তাদের পরিশ্রমের ফসল। ব্যাংকের আইটি কর্মকর্তাদের তৈরি নানা সফটওয়্যার বিভিন্ন সময়ে প্রশংসিত এমনকি একাধিকবার জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছে।
ই-গভর্ন্যান্স ও উদ্ভাবন কর্মপরিকল্পনা ২০২৩-২৪-এর ইনোভেশন প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনী উদ্যোগ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে সোনালী ব্যাংক পিএলসির মোবাইল অ্যাপ সোনালী ই-ওয়ালেট। ২০২০ সালের ৩ জুন ‘সোনালী ই-সেবা’ নামে স্মার্টফোনভিত্তিক একটি অ্যাপ চালু করে সোনালী ব্যাংক, যেটি ব্যবহার করে ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন গ্রাহকরা, ব্যাংকে যেতে হয় না। অ্যাপ থেকেই দুই মিনিটেই অ্যাকাউন্ট খোলা ও চালু করা যায়।
গ্রাহকেরা ছবি এবং ব্যক্তিগত তথ্যের বিবরণী অ্যাপটিতে দিলেই আইসিটি বিভাগের ‘পরিচয়’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভার থেকে সেগুলো যাচাই করে নেওয়া যায়। একইসঙ্গে অন্যান্য তথ্য (কেওয়াইসি) বাংলাদেশ জাতীয় ডিজিটাল আর্কিটেকচারের সাথেও মিলিয়ে নেওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে এই অ্যাপের মাধ্যমে সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতার ভাতাভোগী (বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা ইত্যাদি), গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক, কৃষক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, মৎসজীবী, চাকরিজীবী (বেতন), পেনশনভোগীসহ সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাংক হিসাব খোলা যায়। এছাড়া পরে অন্যান্য ধরনের ব্যাংক হিসাবও এর মাধ্যমে খোলার সুযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইসিটি বিষয়ে গ্রাজুয়েট ও পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের নিয়োগের পর থেকেই ব্যাংকটির আইটি কর্মকান্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এরপরও রাষ্ট্রায়ত্ব এই ব্যাংকটির আইটি কর্মকর্তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা কৌশলে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় যে কৌশল সেটি হলো অর্গানোগ্রাম থেকে ৬৭টি পদ বিলুপ্তির মাধ্যমে পদোন্নতির সুযোগ বন্ধ রাখা ও সে অনুসারে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আটকে দেয়া।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ জানিয়ে বলেন, ব্যাংকের আইটি বিভাগকে সমৃদ্ধ ও সক্ষমতার উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করতে ২০১০ সালে আইটি কর্মকর্তাদের নিয়োগকালে তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাংকের অর্গানোগ্রামটি (জনবল কাঠামো) প্রণীত হয়। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠরা ব্যাংকটির আইটি খাতকে ভারতীয় আইটি পণ্যের বাজারে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালায়।
এই পরিকল্পনার আওতায় সাবেক এমডি প্রদীপ কুমার দত্তের আমলে ভারত থেকে ব্যয়বহুল কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার আমদানি করা হয়। পাশাপাশি ব্যাংকের আইটি জনবলের উন্নয়নে এবং আইটি কর্মকর্তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান বন্ধ রাখে। আবার পদোন্নতির পথ রূদ্ধ করতে কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য জেনারেল ব্যাংকিংয়ে এজিএম সমমানের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের ২৬টি পদসহ বিভিন্ন গ্রেডের মোট ৬৪টি পদ বিলুপ্ত করা হয়।
ফলে আইটির বিভিন্ন গ্রেডের সিংহভাগ কর্মকর্তা প্রাতিষ্ঠানিক সৃষ্ট সংকটে দীর্ঘ ৬-৯ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত হন। এটি তাঁদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশার সঞ্চার করে। বিদ্যমান পদ বিলুপ্ত করে পদোন্নতিতে জট সৃষ্টির ঘটনা ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন তারা। এছাড়া আরো অনেক পদক্ষেপের মাধ্যমে আইটি বিভাগকে সহযোগিতা প্রদানের পরিবর্তে নানা অপকৌশলে তাদের স্বার্থ ক্ষুণœকারী পদক্ষেপ নেয়।
অবশ্য ২০২১ সালে পুনরায় অর্গানোগ্রাম হালনাগাদ করা হলেও ২০১৪ সালে সৃষ্ট পদোন্নতি-জট নিরসন না হওয়ায় তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এমন হঠকারী, বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে ব্যাংকের আইটি কর্মকর্তাদের অনেকেই তাঁদের চেয়ে ৫ বছর পর একই গ্রেডের অন্যান্য বিভাগে যোগদানকারী কর্মকর্তাদের চেয়ে জুনিয়রে পরিণত হয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের মতে, এই বৈষম্যের শিকার না হলে ২০১০ সালে যোগদানকারী অধিকাংশ আইটি কর্মকর্তাই ২০২২ সালেই ৪র্থ গ্রেডে উন্নীত হতেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতনের পর বৈষম্য বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ফ্যাসিবাদের দোসরদের সৃষ্ট দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত এসব বৈষম্যের অবসান ও প্রাপ্য পদোন্নতি প্রদানের জন্য বঞ্চনার শিকার আইটি এসব কর্মকর্তারা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানায়। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অন্যান্য বিভাগের জন্য পদোন্নতির বড় ধরণের সুযোগ তৈরি করলেও রহস্যজনকভাবে আইটি কর্মকর্তাদের নিয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলে জানান তার ব্যক্তিগত সচিব। এরপর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন। ওই জনসংযোগ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমি নিজে ৩০ বছরের চাকরি জীবনে এখন পর্যন্ত ৪টি পদোন্নতি পেয়েছি।
অথচ যারা মাত্র ৯ বছর হলো যোগদান করেছেন তারাও অনেকে ৩টা পদোন্নতি পেয়েছেন। এটা একটা গ্যাপ ছিল, তা ঠিকাছে। কিন্তু এটা তো রাতারাতি সমাধান করা যাবে না। তবে এটা নিয়ে এখন কাজ চলছে, একটু সময় দিতে হবে।
শুধু আইটিতে নয়, আরো অনেক বিভাগে এ ধরণের অবস্থা চলমান রয়েছে বলে এই কর্মকর্তা জানান। তবে কেন এ ধরণের বৈষম্যমূলক কার্যক্রম চলছে ব্যাংকটিতে সে সম্পর্কে তথ্য দিতে না পারলেও জানান, এ ধরনের ঘটনা আরো আগে থেকেই ঘটে আসছে। কারণ সে সময় তারা (পর্ষদ) সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেনি। তবে সঠিক তথ্য মানবসম্পদ বিভাগ দিতে পারবে বলেও তিনি জানান।