![বাধ্যতামূলক ছুটিতে ছয় ব্যাংকের এমডি বাধ্যতামূলক ছুটিতে ছয় ব্যাংকের এমডি](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/f1-2501051633.jpg)
৬ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে
বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠিত টাস্কফোর্সের পরামর্শে ৬ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ সকল ব্যাংকের এমডিদের ছুটিতে পাঠানোর বিষয়টি নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের আলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবং ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর একদিন পর এই পাঁচ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাকে ছুটিতে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শনিবার দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এস আলম গ্রুপকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ ছাড়ে তার দায়িত্বে অবহেলা পায় কর্তৃপক্ষ। রবিবার থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটিতে থাকবেন তিনি।
জানা গেছে, এডিবির অর্থায়নে ৬টি ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট শুরু করছে বিদেশী অডিট ফার্ম। স্বচ্ছতার সঙ্গে অডিট সম্পন্ন করতে তারা চায় বর্তমান এমডিরা কেউ দায়িত্বে না থাকুক। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠাতে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। তবে অডিটে কারও অনিয়ম পাওয়া না গেলে তারা আবারও স্বপদে ফিরতে পারবেন। বিএবির ভাইস চেয়ারম্যান ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে অডিট সম্পন্ন করার জন্য এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কারও দায় প্রমাণিত না হলে তিনি আবার ফিরতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিবিড় অনুসন্ধান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো থেকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিপুল পরিমাণ ঋণ নামে-বেনামে বের করে নিয়ে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
এ অর্থ এখন আর ব্যাংকে ফেরত আসছে না, ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলছে। গতমাসে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ বিধান জারি করেছে। এ বিধানের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিভিত্তিক সমন্বিত নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক, হুসনে আরা শিখা জনকণ্ঠকে বলেন, ৬ ব্যাংকের এমডি ছুটিতে থাকবেনÑ এটা ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। এই ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় অডিট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অডিটের এই মুহূর্তে এমডিগণ যেন অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে না পারেন সে কারণে তাদেরকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অডিট প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ রাখতেই এই ব্যবস্থা।
অডিটের মাধ্যমে যদি দেখা যায় তারা কোনো প্রকার অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নন। তাহলে আবার তারা যথারীতি কাজে যোগদান করতে পারবেন। যদি অনিয়মের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্র্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে করা হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। সরকার পরিবর্তনের পর গত ১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে। ২০১৭ সালে এস আলম ইসলামী ব্যাংক দখলের সময় আব্দুল মান্নানকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করানো হয়।
পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমরা অডিটকে স্বাগত জানাই। নতুন দিনের একটি অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি, ব্যাংকটিকে জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে। এজন্য অডিট খুবই কাজে লাগবে।’ এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘এমডি যেহেতু সে সময়ে (আগের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সময়ে) ছিলেন, তাই তাকে দায়িত্বে রেখে অডিট প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কোনো বিতর্ক যাতে না ওঠে, নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে তাকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট সময়ে হওয়া সব ধরনের লেনদেন যাচাই-পর্যালোচনা ও কোনো তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে কি না, তা দেখতে এই ফরেনসিক অডিটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স। সেই সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালিয়ে যান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে। ২০ আগস্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ বিলুপ্তের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এখন পুনর্গঠিত পর্ষদের মাধ্যমে কীভাবে ব্যাংকগুলোর উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।
অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে এর আগে বেসরকারি খাতের সাত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। তবে পর্ষদ পুনর্গঠন করে গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছে এসব ব্যাংক।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, মনে হয় বাংলাদেশে ডুবে যাওয়া ব্যাংক খাতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে টাস্কফোর্সের পরামর্শে আন্তর্জাতিক আইনে কমপক্ষে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, দখলদারদের হাত থেকে ব্যাংক উদ্ধার এবং কাগুজে নোট ছেপে ব্যাংকের তারল্য সংকট না কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে করছেন তারা। তবে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকের এখনো তারল্য সংকট আছে।
ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সিলিং তুলে দেওয়া হলেও এখনো কোনো কোনো ব্যাংক বড় অংকের চেকে টাকা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে। ৮ আগস্ট অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার ড. আহসান এইচ মনসুরকে। দু’জনই ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের কথা, তারা যে উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছেন তা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরে আসবে আর সুশাসন ফিরে এলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটবে, গ্রাহকের আস্থা ফিরে পাবে ব্যাংকগুলো।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যাংক কোম্পানি আইন ভেঙে নজিরবিহীনভাবে সাতটি ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নেয়। সাইফুল আলম তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও কিছু আত্মীয়কে একাধিক ব্যাংকের বোর্ডে বসান। সাইফুল আলম নিজে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ চারজন ছিলেন বোর্ডে। তাদের ছেলে আহসানুল আলম, মেয়ে মাইমুনা খানম ও জামাতা বেলাল আহমেদ যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন।
সাইফুল আলমের ভাই, বোনসহ অন্যান্য আত্ময়ীরা বেশকটি ব্যাংকের পর্ষদে ছিলেন। এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ১১ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়।
এর মধ্যেই সরকার অনিয়মে জর্জরিত আর্থিক খাতের সংস্কারে শ্বেতপত্র প্রকাশের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে কারিগরি ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্র্রস্তাব দেয়। বিশ্ব ব্যাংকও ফরেনসিক অডিট করতে সহযোগিতার কথা বলে। এরপরই সবচেয়ে বেশি সমস্যাগ্র্রস্ত ছয়টি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিটের সিদ্ধান্ত হয়।