.
কয়েক মাস স্থিতিশীল থাকলেও আবারো ডলারের বাজারে চলছে অস্থিরতা। ব্যাংক থেকে খোলা বাজার ডলারের দেখা মেলা ভাগ্যের ব্যাপার। বিপাকে পড়ছে বিদেশে ভ্রমণ ইচ্ছুক সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে ১২২ টাকা দরে ডলার বিক্রির ড্যাস বোর্ডের ঘোষণা শুধুই কাগজেকলমে। বাস্তবে ডলার পাচ্ছেন না গ্রাহক। গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে বিকল্প মুদ্রা সরবরাহ করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এদিকে ব্যাংকে ডলার না পেয়ে ডলার কিনতে অনেকে ঘুরছেন খোলা বাজারে। এই বাজারেও সংকট রয়েছে ডলারের। গ্রাহকদের ডলার পেতে গুনতে হবে অন্তত ১২৭ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত।
মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এস এম জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের আয়ের প্রতি ডলার কিনছেন ১২৫ টাকার ওপর। বিপরীতে আইনের মধ্যে থাকতে হলে মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে ডলার বিক্রি করতে হবে ১২১ টাকা দরে, যা বাস্তব নয়। তাই বাধ্য হয়েই অবৈধ পথে হাঁটতে হয় মানি একসচেঞ্জ হাউজগুলোকে। বর্তমানে
নগদ ডলারের বাজার অস্থিরতা হওয়ার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুষলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বিনিময় হার বাড়ানো হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। তাই শর্ত নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ তাদের।
এদিকে আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসেবে ডলারের বিনিময় হার বাজার দরের ওপর ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েছিল। শর্ত মেনে বেঁধে দেওয়া বিনিময় হার থেকে সরে আসার চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত প্রথমে ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হলেও পরে ক্রলিং পেগ ঘোষণা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। গত মে মাসে একবারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা। এর পর বেশ কিছুদিন ১২০ টাকার আশপাশে লেনদেন হয়।
রবিবার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায় ডলারের দাম বাড়ার কারণে অনকটাই অস্থির হয়ে উঠছে খোলা বাজার। অনেক ব্যাংক রেমিটেন্স কিনছে ১২৫ থেকে ১২৬ টাকায়। ফলে, ঋণপত্র খুলতে প্রতি ডলারে গুনতে হয় ১২৬ টাকার বেশি। আর খোলাবাজারে লেনদেন হচ্ছে ১২৮ টাকা পর্যন্ত। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে ক্রলিং পেগের কার্যকারিতা নিয়েও। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের কাছে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে আশা করছি শীঘ্রই এর সমাধান পেয়ে যাব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। আইএমএফের শর্ত মেনে নতুন ক্রলিং পেগ বাস্তবায়নে ডলারের দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা আরও কঠিন হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ জনকণ্ঠকে বলেন, ডলার বাজারে যে অস্থিরতা দেখছি, এটা কাম্য ছিল না। ৫ আগস্টের পর দেশ অস্থিরতার মধ্যে বিরাজ করছিল। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বাংকের নতুন নেতৃত্ব ভালোই চলছিল কিন্তু হঠাৎ করে ডলারের দাম বৃদ্ধি আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ন্ত্রণে না এলে ‘ডেপ্রিসিয়েশন’ অবধারিত হবে। মূল্যস্ফীতি যেখানে ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে ১১৭ টাকার ক্রলিং পেগ বা মার্কেটে ১১৯-১২০ টাকা, সেটা যদি এখন যা আছে ১২৬-১২৭ টাকায় চলে যায় তা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, মূলত তিনটি কারণে ডলারের দর বাড়ছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) শর্ত অনুযায়ী বছর শেষে নির্ধারিত পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দ্বিতীয়ত, রমজান কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে গতি বেড়েছে। এতে আমদানি দায় পরিশোধের চাহিদাও বেড়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওভারডিউ (বকেয়া) হয়ে যাওয়া সব ঋণপত্রের (এলসি) দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে। এদিকে, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ন্যূনতম ১ হাজার ৫৩২ কোটি বা ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এ শর্ত পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা বাড়ানোর বিষয়টিও মার্কিন মুদ্রাটির বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টানা দুই অর্থবছর আমদানি ঋণাত্মক থাকার পর চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ২২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। নভেম্বর ও চলতি মাসে আমদানির এলসি খোলাও বেড়েছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ উঠেছিল ২০২১ সালের আগস্টে, তখন ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনাপরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় ডলার বিক্রি করলেও দর ঠেকানো যায়নি। আবার অনেক ধরনের বকেয়া পরিশোধ না করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে টানা তিন অর্থবছর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি বা ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর তা আরও বেড়ে পৌঁছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়নে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় আরও ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। টানা তিন অর্থবছর ডলার বিক্রির কারণে রিজার্ভে বড় ক্ষয় হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নে)। সে রিজার্ভ এখন ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছেন। সেই সঙ্গে আইএমএফের শর্ত পূরণে বাজার থেকে ডলার কিনছেন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডলারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জোগান নিশ্চিত না করতে পারলে দাম বেড়েই যাবে। ডলারের দাম চাপিয়ে রেখে এটা ঠেকানো সম্ভব নয়। ডলারের দাম ঠিক রাখতে হলে তা বাজারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।