.
প্রতি লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ানোর পরও খুচরা বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে আগের মতো বেশি দামে। এদিকে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাইস ব্র্যান অয়েল বা ধানের কুড়ার তেল রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে শুল্কারোপের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সংস্থাটি এজন্য অপরিশোধিত ও পরিশোধিত উভয় ধরনের কুড়ার তেল রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপের সুপারিশ করেছে।
এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম কমলেও বেড়েছে চাল, মুরগি মাছের দাম। ডাল, আটা ও চিনির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। সরবরাহ বাড়ায় কমতে শুরু করেছে শাক-সবজির দাম। শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজার, ফকিরাপুল বাজার, কাপ্তান বাজার, খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচা বাজার এবং মালিবাগ রেলগেট বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। খুচরা দোকানগুলোতে দু-একটি ব্র্যান্ড ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির সয়াবিন তেল মিলছে না। এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে চালের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে কমেছে নতুন আলু ও পেঁয়াজের দাম। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দাম বাড়ানো হলেও ডিলাররা এখনো খুচরা দোকানগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ শুরু করেননি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও এক-দুই দিন সময় লাগতে পারে।
এদিকে কয়েক মাস ধরেই সয়াবিন তেলের বাজারে অস্বস্তি রয়েছে। বিশেষ করে সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছিল। ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে গত সোমবার সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ায়। এরপর চারদিন পার হলেও খুচরা বাজারে তেলের সরবরাহ ঠিক হয়নি। মিলমালিক ও পাইকারদের কাছে আগের আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুত রয়েছে। কম দামে আনা সেই তেল এখন বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা যায় হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে শুধু তীর ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। আর অনেক দোকানে তেল ছিলই না। খিলগাঁও সিটি করপোরেশন বাজারের বিক্রেতা মাহবুব হাসান টিটু জানান, দুদিন ধরে তার দোকানে কোনো ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে না। ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা তেলের বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি। অন্যদিকে বাজারে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাইস ব্র্যান অয়েল বা ধানের কুড়ার তেল রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে শুল্কারোপের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সংস্থাটি অপরিশোধিত ও পরিশোধিত উভয় ধরনের কুড়ার তেল রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপের সুপারিশ করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া এক চিঠিতে এই প্রস্তাব করে ট্যারিফ কমিশন। এ ছাড়া কুড়া, অপরিশোধিত ও পরিশোধিত কুড়ার তেল রপ্তানিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদনের শর্ত আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। তথ্যমতে, বর্তমানে ধানের কুড়া রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এখন অপরিশোধিত ও পরিশোধিত কুড়ার তেল রপ্তানিতে একই হারে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে বিটিটিসি। সংস্থাটি বলেছে, স্থানীয় বাজারে যৌক্তিক মূল্যে পরিশোধিত ধানের কুড়ার তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই শুল্কারোপ করা প্রয়োজন। রমজান মাস সামনে রেখে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে সার্বিকভাবে স্থানীয় বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়বে। দামের ক্ষেত্রেও স্বস্তি তৈরি হবে বলে কমিশন মনে করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরকে দেওয়া চিঠিতে ট্যারিফ কমিশন জানায়, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২২-২৩ লাখ টন। এই চাহিদার বিপরীতে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করে স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের মাধ্যমে চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ করা হয়। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত কুড়া থেকে বছরে ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টন অপরিশোধিত এবং সাড়ে ৫-৬ লাখ টন পরিশোধিত কুড়ার তেল পাওয়া সম্ভব। এই পরিমাণ কুড়ার তেল দিয়ে ভোজ্যতেলের মোট স্থানীয় চাহিদার ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী জানিয়ে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কুড়ার তেলের সরবরাহ বৃদ্ধির আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, দেশে বর্তমানে ১ লিটার বোতলজাত কুড়ার তেলের দাম ১৯৫-২০৫ টাকা, আর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৭২-১৭৫ টাকা। এ ছাড়া প্রতি লিটার খোলা পাম তেলের দাম ১৬০-১৬১ টাকা। বাংলাদেশ রাইস ব্র্যান অয়েল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, দেশে মোট ২০টি রাইস ব্র্যান অয়েল মিল রয়েছে। এসব মিলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। উল্লেখ্য, দেশের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার পাম ও সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ককর কমিয়েছে। এতে প্রতি কেজি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ককর ১০-১১ টাকা কমেছে। কিন্তু সরকার শুল্ককর কমালেও আমদানি বাড়েনি, বরং বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম এখন বাড়তি। সরকার শুল্ককর কমানোর ফলে বাজার খুব বেশি অস্থিতিশীল হয়নি। আবার আমদানি সাময়িকভাবে কমলেও সামনে বাড়তে পারে। অন্যদিকে ভোক্তাদের অভিযোগ, দামে কোনো সুখবরই নেই। বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট রয়েছে।
এদিকে বাজারে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে বেশি বেড়েছে সরু চালের দাম। খুচরা পর্যায়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু প্রজাতির নাজিরশাইল চালের দাম কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার পর মানভেদে প্রতিকেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকায়। একইভাবে রসিদসহ অন্যান্য মিনিকেট চালের দামও ২-৩ টাকা করে বেড়েছে। অন্যদিকে সরু চালের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে মোটা চালের ওপরও। ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের মোটা চালের দাম ১-২ টাকা বেড়েছে। বর্তমান প্রতি কেজি মোটা চাল ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। চালের পাইকারি বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের একাধিক বড় মিল থেকে বাজারে চাল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাবে দাম বেড়েছে। এ ছাড়া আলু পেঁয়াজ ও সবজিসহ কিছু মুদি পণ্যেরও দাম কমেছে। দাম কমে প্রতি কেজি নতুন আলু ৯০, পুরনো আলু ৭৫, প্রতি কেজি পেঁয়াজ জাত ও মানভেদে ৯০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এ ছাড়া সরবরাহ বাড়ায় কমতে শুরু করেছে শীতকালীন সবজির দাম। গড়ে প্রতি কেজি সবজি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে দাম বেড়ে ব্রয়লার মুরগি ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দাম কমে প্রতিডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। এ ছাড়া মাছের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে।