ছবি: সংগৃহীত
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে দেশের ব্যাংক খাতে। এ সময় দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা জাতীয় ১৩ টি মেট্রোরেল অথবা ২২ টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। এসব অর্থের বেশির ভাগই পাচ হয়ে গেছে দেশের বাইরে। সরকারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক পত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাতকে ব্ল্যাক হলে সাথে তুলনা করে বলেছে বর্তমান বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আর এসব লুটপাটে সরাসরি সহযোগিতা করেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো। কমিটি আরো জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। কেবল কেবল এস আলম গ্রুপের কাছে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছিল। এ সময় নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছিল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও। রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়েছে নীতিমালা সহ ব্যাংক আইন। দায়িত্ব পালন করেননি স্বতন্ত্র পরিচালকেরা। এমনকি অভ্যন্তরীণ ও বহি: নিয়ন্ত্রক যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।
বাংলাদেশের এসব দুর্নীতিবাজদের অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাহিরে। বেশিরভাগ বড় দুর্নীতিবাজরা পালিয়ে গেছেন। ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ।
দুর্নীতিবাজদের নামে তাড়াহুড়ো করে যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে দুর্নীতির মামলা না করে করা হয়েছে হত্যা মামলা। যেগুলো শেষ পর্যন্ত আদালতে টিকবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
তবে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির সাজা দেওয়ায় সম্প্রতি এক উদাহরণ তৈরি করেছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের অন্যতম শীর্ষ ধনী ট্রুং মাই লান ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এর রায় দিয়েছে দেশটির আদালত। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে যে মডেল এ লুটপাট চালানো হয়েছে তিনিও সেভাবে ভিয়েতনামের ব্যাংক থেকে লুটপাট চালিয়ে ছিলেন।
অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে ট্রুং মাই লান প্রচলিত ও জনপ্রিয় পথেই হেঁটেছেন। ভিয়েতনামের আইন অনুসারে, একজন ব্যক্তি ব্যাংকের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা অর্জন করতে পারেন। আইনানুসারে, কাগজে-কলমে ট্রুংও ছিলেন সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। তবে পরোক্ষভাবে বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে তিনি ব্যাংকটির ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। ২০১১ সাল থেকে ১১ বছর ধরে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ ও নগদ হিসেবে তিনি ও তার সহযোগীরা ব্যাংকটি থেকে ৪৪ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ। এর মধ্যে অবশ্য ১ হাজার ২০০ কোটি বা ১২ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণ করতে পেরেছেন আইনজীবীরা।
অভিযোগ রয়েছে, অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়া মসৃণ করতে ট্রুং মাই লান ব্যাংক কর্মকর্তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বড় অংকের ঘুস দিয়েছিলেন। তার বেআইনি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার বিনিময়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সাবেক প্রধান পরিদর্শক ৫০ লাখ ডলার ঘুস নিয়েছিলেন বলে স্বীকারও করেন।
ট্রুং মাই লানের অর্থ আত্মসাতের বিচার প্রক্রিয়াও ছিল বেশ বড় আকারের কর্মযজ্ঞ। হো চিন মিন সিটির পিপলস কোর্টে এ বিচারের সময় ৮৫ জন বিবাদী, ২ হাজার ৭০০ সাক্ষী, রাষ্ট্রীয় ১০ আইন কর্মকর্তা ও ২০০ আইনজীবী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ জায়গা দিতে ১০৪টি বাক্সের দরকার হয়েছিল এবং এর ওজন ছিল ছয় টন। বিচারে সব বিবাদীই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ট্রুং মাই লান পেয়েছেন সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড। তার স্বামীর ৯ বছর ও ভাতিজির ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
গত অক্টোবরে পৃথক একটি মামলায় ট্রুং মাই লানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, প্রতারণা, অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সীমান্তের বাইরে অর্থ নেয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক্ষেত্রে ২৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার তছরুপ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে ট্রুং মাই লান আপিল করেছিলেন, যা গত ৩ ডিসেম্বর খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। তবে ভিয়েতনামের আইন অনুসারে, আত্মসাৎ করা অর্থের তিন-চতুর্থাংশ ফেরত দিলে সাজা মওকুফের সুযোগ রয়েছে। আদালত তার রায়ে জানিয়েছিলেন, ট্রুং মাই লানের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হবে, যদি তিনি ৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেন। তবে বিদ্যমান অবস্থায় তিনি তার সম্পত্তি বিক্রি করে জরিমানার অর্থ সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে এসেছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকেও বিগত সময়ে ভিয়েতনামের মডেলে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাত থেকে ২ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বলে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছিলেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গোয়েন্দা সংস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় ব্যাংক দখল, বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার কিনে ব্যাংকের পরিচালক হওয়া এবং একক গ্রাহক ঋণসীমার ফাঁদ এড়াতে বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে একই গ্রুপের অনুকূলে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। পাচার হওয়া এসব অর্থে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও কানাডার মতো দেশে সম্পত্তি কেনার প্রমাণও পাওয়া গেছে। অবশ্য এসব পাচারকারীর সিংহভাগই আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে।
ব্যাংকাররাও মনে করছেন ব্যাংকের অর্থ লুট ও পাচারের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এগুলো ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে অর্থ আত্মসাতের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে আত্মসাৎ করা অর্থ উত্তরাধিকারীদের ভোগের সুযোগ থাকবে, যেটি কাম্য নয়। এক্ষেত্রে আত্মসাৎকারীদেরই সামাজিকভাবে হেয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থ আত্মসাৎ করে ধরা পড়লে চরমভাবে অপদস্থ হতে হবে এমন ভয় তৈরি করতে হবে। তাহলে এ প্রবণতা কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।
শিহাব