ব্যাংকখাত ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত
ব্যাংকখাত ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত, এরপর রয়েছে ভৌত অবকাঠামো এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতটিও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে একটি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের কাছে রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত দুর্নীতির চিত্র, বিশেষত সরকারি সম্পদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংকখাত ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত, এরপর রয়েছে ভৌত অবকাঠামো এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতটিও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে একটি।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বিগত আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে।
শ্বেতপত্রের খসড়ায় ২৮ ধরনের দুর্নীতি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-
১. ব্যাংকখাতে ঋণ জালিয়াতি ॥ ব্যাংক ঋণ জারির ক্ষেত্রে জালিয়াতি, অনিয়ম ও ঋণের অপব্যবহার ইত্যাদি।
২. ব্যাংক দখল ॥ রাষ্ট্রীয় শক্তির অন্যায্য ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা দখল নেওয়া।
৩. বিদেশে বিপুল অর্থপাচার ॥ অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
৪. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া অবাস্তব প্রকল্প ॥ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয় এমন সব প্রকল্প গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা হয়েছে, এসব প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়ও বারবার বাড়ানো হয়েছে।
৫. ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো ॥ প্রকল্পের বরাদ্দ আত্মসাৎ করে তা পাচারের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
৬. প্রকল্প অনুমোদনের পর দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো ॥ প্রকল্প অনুমোদনের পর কৃত্রিমভাবে ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়, যাতে নতুন বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ করা যায়।
৭. একচেটিয়া দরপত্র প্রক্রিয়া ॥ রাজনৈতিক সমর্থক, অনুগত ও তোষণকারীরা যেন দরপত্র পায় তা নিশ্চিত করা হয়, এতে বাদ পড়ে যান যোগ্য ঠিকাদাররা।
৮. অদরকারি ও দুর্বল প্রকল্প প্রণয়ন ॥ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিকভাবে না করার ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের অপচয় হয়েছে, বেড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ও ব্যয়।
৯. নিয়োগে স্বজনপ্রীতি বা দলীয়করণ ॥ প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, বিশেষত প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই তাদের মেধা বা যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
১০. অবৈধভাবে জমি ও সম্পত্তি দখল ॥ অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ জমি ও অন্যান্য সম্পদ দখল বা কিনেছে বিগত সরকারের লোকজন।
১১. ভূমি অধিগ্রহণের তহবিলের নয়-ছয় ॥ রাজনৈতিকভাবে দুর্বল বা যাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্রব নেই- এমন জমির মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কম দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছে, অন্যদিকে সরকারি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের টাকা নিয়ে দুর্নীতি করা হয়েছে।
১২. অতি-মূল্যায়িত ঠিকাদারি চুক্তি ॥ প্রতিযোগিতামূলক দর আহ্বান না করে, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাব থাকা ঠিকাদারদের বেশি দরে সরকারি কাজের ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে।
১৩. প্রকল্পের সম্পদের অপব্যবহার ॥ প্রকল্পের জন্য কেনা গাড়ি, ভ্রমণের বাজেট ও অন্যান্য সম্পদ সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে এবং রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ব্যবহার করেছে।
১৪. ঘুষ হয়ে পড়েছিল স্বাভাবিক ॥ সরকারি কাজ পাইয়ে দেওয়া বা দ্রুত কোনো কাজ করাতে হলে- সেবাপ্রার্থীদের ঘুষ প্রদান করতে হয়েছে।
১৫. সরকারি তহবিলের অপব্যবহার ॥ উন্নয়নের জন্য অভীষ্ট তহবিল নিজেদের রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক নেতারা।
১৬. অভিজাতদের কর অব্যাহতি প্রদান ॥ প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দিতেই প্রণীত হয় বিভিন্ন রকম অব্যাহতিমূলক কর নীতি।
১৭. বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খলে অসাধুতা ॥ বাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সরবরাহ চক্রে কারচুপি করে অন্যায্যভাবে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ভোক্তারা, দুর্বল হয় বাজার ব্যবস্থাপনা।
১৮. সরকারের গোপন তথ্য প্রদান ॥ বিশেষ কিছু গোষ্ঠী ও মহলকে সুবিধা দিতে সরকারের অনেক নীতিসিদ্ধান্তকে তাদের কাছে ফাঁস করা হয়েছে।
১৯. যোগসাজশের ভিত্তিতে দুর্নীতি ॥ সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তা বা যোগসাজশে বিভিন্ন দুর্নীতি করতে পেরেছে বেসরকারি খাতের লোকজন, যার ফায়দা লুটেছে দুইপক্ষই।
২০. শোষণমূলক দুর্নীতি ॥ জোর করে চাঁদাবাজি, ঘুষ নেওয়া বা ভুক্তভোগীদের অন্যায় চুক্তি সইয়ে বাধ্য করেও দুর্নীতি করা হয়েছে।
২১. একচেটিয়া বাজার দখলের দুর্নীতি ॥ নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সুবিধার্থে বাজারে কারসাজি করা হয়েছে।
২২. আগাম তথ্য ফাঁস করে দুর্নীতি ॥ পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আগাম ফাঁস করে সংশ্লিষ্টরা অন্যায় সুবিধা নিয়েছে।
২৩. তথ্য গোপন করেও দুর্নীতি ॥ অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রেখেও অংশীজনদের বিভ্রান্ত করা হয়, বা বিপথে চালিত করা হয়।
২৪. নিষ্ক্রিয় থেকে দুর্নীতি ॥ সরকারি কাজকর্মের ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয় থেকে সেবাপ্রত্যাশীর ওপর ঘুষ প্রদানের চাপ তৈরি করতেন।
২৫. পদোন্নতির জন্য দুর্নীতি ॥ সরকারি চাকরির ঘুষের টাকা ও রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে উচ্চতর পদে পদোন্নতির তদ্বির করতেন কর্মকর্তারা।
২৬. কমিশন ভাগাভাগির দুর্নীতি ॥ সরকারি বিভিন্ন কাজের অনুমোদন দিতে মোটা অঙ্কের কমিশন বা বখরা নিয়ে ভাগাভাগি করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
২৭. রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতে দুর্নীতি ॥ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতে সরকারি সম্পদের অপব্যবহার হয়েছে, সরকারি নীতিরও হেরফের করা হয়েছে, এবং
২৮. আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দুর্নীতি ॥ স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধার্থে সরকারের বিভিন্ন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।