ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

৫০টি পণ্যের দাম নিয়ে নতুন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করা হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ১ ডিসেম্বর ২০২৪

৫০টি পণ্যের দাম নিয়ে নতুন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করা হবে

৫০টি আইটেমের দর ওঠানামার ভিত্তিতে প্রকাশ করা হবে মূল্যস্ফীতি

বিদ্যমান সিপিআই ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যবহার করা হবে এই নতুন পদ্ধতি। নতুন এই পদ্ধতিতে বেশি বেশি ভোগ হয় এমন ৫০টি আইটেমের দর ওঠানামার ভিত্তিতে প্রকাশ করা হবে মূল্যস্ফীতি।
বাজার পরিস্থিতির আরও সঠিক চিত্র পেতে বিদ্যমান পদ্ধতির পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি হিসাবের একটি নতুন পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলছেন, কোর ইনফ্লেশন নামের এই পদ্ধতিতে দেশের মানুষ বেশি বেশি ভোগ করে এমন ৫০টি পণ্যের দামের ওঠানামা নিয়ে নতুন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হবে। তবে এই ৫০টির মধ্যে কী কী পণ্য থাকবে, তা এখনো ঠিক করেনি বিবিএস।
তবে বিবিএস বলছে, নতুন এই পদ্ধতিতে যেসব পণ্যের দরে অস্থিতিশীলতা থাকে, সেগুলোর হিসাব করা হয় না। জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, মৌসুমি সবজির মতো যেসব পণ্যের দাম মৌসুমে কমে, আবার মৌসুমের পরে বাড়ে এ ধরনের পণ্য এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয় না। 
কোনো কোনো পণ্য নিয়ে মূল্যস্ফীতির এই নতুন হিসাব প্রকাশ করা হবে, তা ঠিক করতে বিবিএসের একটি কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। আরও একটি কমিটিও গঠন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। 
বর্তমানে জাতিসংঘের গাইডলাইন অনুযায়ী বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়, যাকে বলা হয় কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই)। এ পদ্ধতিতে ৭৪৯টি পণ্য ও সেবার বাজারদর ওঠানামার ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এরমধ্যে ২৪২টি খাদ্যপণ্য এবং ৫০৭টি খাদ্য-বহির্ভূত পণ্য ও সেবা রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলার ১৫৪টি হাটবাজার থেকে নির্ধারিত সময়ে তথ্য নিয়ে বিবিএস সিপিআই পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে। তবে এই ৭৪৯টি আইটেমের মধ্যে বেশ কয়েকটি আইটেম রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশে ভোগ হয় না।
সূত্রমতে, বেশিরভাগ দেশ মূল্যস্ফীতির প্রধান হিসাবের জন্য সিপিআই পদ্ধতি ব্যবহার করে। তবে নীতি নির্ধারকদের মূল্যস্ফীতির প্রকৃত প্রবণতা বোঝার সুবিধার্থে অনেক দেশ দ্বিতীয় প্রধান পদ্ধতি হিসেবে কোর ইনফ্লেশন পদ্ধতি অনুসরণ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোর ইনফ্লেশন পদ্ধতি যৌক্তিক। এ পদ্ধতিতে বেশি ব্যবহৃত পণ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা মূল্যস্ফীতির আরও সঠিক ও স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরে। এ বিষয়ে ২৬ নভেম্বর বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন মহলের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি হিসাবের এই নতুন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অর্থ উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিবিএস এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। কিভাবে কাজটি করা যায়, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কোন কোন আইটেম অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেটা নিয়ে একটা ফরমাল মিটিং ডাকা হবে। সম্ভবত ৫০ বা ৬০টি আইটেম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘আগের মূল্যস্ফীতির হিসাবও থাকবে। পাশাপাশি এটি নতুনভাবে প্রকাশ করা হবে। কোর সিপিআই প্রকাশ করা হলে আরেকটু রিয়েল পিকচার আসবে। ‘কাজ শুরুর পরে প্রথম আউটপুট দিতে কমপক্ষে ৬ মাস লাগবে। কারণ, এর কাজ অনেক পেছন থেকে শুরু করতে হয়, বলেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ১০.৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত কয়েক মাসে সর্বোচ্চ। এ সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার নীতি সুদহার বাড়ালেও মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এরপরেই রয়েছে মাছ। এসব পণ্যের দাম সামান্য বাড়লেই মূল্যস্ফীতি অনেকটা বেড়ে যায়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোর ইনফ্লেশন হিসাব করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ বরং এ ধরনের হিসাব পদ্ধতি চালু করতে দেরি করে ফেলেছে।
আমাদের ইনফ্লেশন বাস্কেটে অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো সাময়িক প্রয়োজন বা বছরে এক-দুইবার ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে কোর ইনফ্লেশন হিসাব করার যৌক্তিকতা রয়েছে। এতে মানুষ বেশি বেশি ব্যবহার করে, এমন পণ্যের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, কোর ইনফ্লেশন একটি ধারণা। মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত সেটা হিসাব করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই হিসাবে জ্বালানিসহ আরও অনেক পণ্য থাকে না। ফলে সিপিআই হচ্ছে প্রকৃত চিত্র। মানুষের আয়ের কতভাগ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, জীবনমান কেমন, সেটা বোঝা যায় সিপিআইয়ের মাধ্যমে। কোর ইনফ্লেশন থেকে সেটা বোঝা কঠিন। তবে বিবিএসের কর্মকর্তারা কোর ইনফ্লেশনের চেয়ে স্পেশাল সিপিআই করা উচিত বলে মনে করেন। স্পেশাল সিপিআই হচ্ছে নি¤œ-আয়ের মানুষ বেশি ভোগ করে এমন পণ্যের দরের ওঠানামা নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা।
বিবিএসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্পেশাল সিপিআই করা দরকার। এতে নি¤œ-আয়ের মানুষ ভোগ করে এমন সকল পণ্যের দর বিশ্লেষণ করা হবে। ফলে কোন পণ্যের দর কেন বাড়ছে, তা বের করা যাবে। তখন সরকার ওইসব পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেশিরভাগ সময়ে চাহিদার কারণে হয় না, সরবরাহজনিত সমস্যার কারণে হয়ে থাকে।

উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত বারবার হাত বদল, পণ্য সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেশনের ফলে মূল্যস্ফীতি হয়। এই সমস্যার সমাধানে নীতি উদ্যোগের চেয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি বলে তারা মনে করেন। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটি অভিযোগ তুলেছে, আগের সরকার মূল্যস্ফীতির তথ্য নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী প্রকাশ করেছে।

×