রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক শতাংশ কমেছে
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক শতাংশ কমেছে। উন্নয়ন খরচ বড়িয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের যে পরিকল্পনা তা বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও অর্থনৈতিক মন্দা এড়াতে সরকারি উন্নয়ন খরচ বাড়ানোর পরিবর্তে কমাতে হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, চলমান আর্থিক পরিস্থিতিতে সরকারের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া কঠিন। অন্যদিকে বিদেশী ঋণের প্রতিশ্রুতি আগের বছরগুলোর তুলনায় কমেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে এক লাখ এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি ৩০ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা কম। বিগত সরকার চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
গত আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে।
অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডি সম্প্রতি জানিয়েছে, উন্নয়ন খরচ গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনি¤েœ পৌঁছেছে। এ কারণে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও অর্থনৈতিক মন্দা এড়াতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের নীতি সমন্বয়ের ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় জুলাই ও আগস্টে রাজস্ব আদায় বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্লেষকরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক বলেন, বিদ্যমান রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব। এ বছর এটি অর্জনের সম্ভাবনা নেই। তিনি মনে করেন, জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী অস্থিরতা ছাড়াও দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমদানিতে ধীরগতি ও নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড় শুল্ক কম আদায়ে ভূমিকা রেখেছে।
জুলাই থেকে অক্টোবরে রাজস্ব প্রশাসন এক মাসে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় সার্বিক রাজস্ব আদায় নিয়ে আশাবাদী এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় এখনো আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে। আশঙ্কা করেছিলাম এটি মারাত্মকভাবে কমতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হবে। পাশাপাশি সে অনুযায়ী বাজেট সংশোধন করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
তবে তাৎক্ষণিক ক্ষতি ঠেকাতে কর ফাঁকি কমানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা রাজস্ব বোর্ডের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। সরকারের খরচের বিষয়ে তিনি বিকল্প কম বলে মনে করছেন। বিকল্পগুলো মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, টাকার অভাব ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। তাছাড়া বিদেশী দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের প্রতিশ্রুতি এখনো কম।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ পেয়েছে। এক বছর আগে এই ঋণের প্রতিশ্রুতি ছিল ২৮০ কোটি ডলার। এম এ রাজ্জাক রাজস্ব বোর্ডকে গতিশীল করার পাশাপাশি বন্দরের কার্যক্রম সহজ করা ও করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি অটোমেশনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পক্ষে মতো দিয়েছেন।
তিনি বলেন, শুধু রাজস্ব প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করা উচিত নয়। চলমান সংস্কার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মূল্য সংযোজন কর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। অন্যদিকে আয়কর ও শুল্ক সামান্য বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে শুল্ক আদায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়ে ৩২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা হয়েছে। আয়কর আদায় এক দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়ে এক লাখ এক হাজার ২৮১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায় চার দশমিক ৮৭ শতাংশ কমে ৩৬ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা হয়েছে।