ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সামুদ্রিক সম্পদ

গতিশীল করবে অর্থনীতির চাকা

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ১৯:০১, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

গতিশীল করবে অর্থনীতির চাকা

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনার কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি হলো সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্র অর্থনীতি বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমেই স্থলভাগের সম্পদের থেকে সমুদ্রের জলরাশির নিচে ডুবে থাকা সম্পদের দিকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর চোখ পড়ছে। সত্যিকার অর্থেই সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের প্রাপ্যতা ও তার সঠিক ব্যবহারের ওপরেই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতি প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ভর করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করা পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ এসব ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হচ্ছে। ভূখণ্ডের কৃষি জমি দখল করে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিচ্ছে মানুষ। বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে প্রতি বছর। ফলে কৃষি জমির বাইরে খাদ্যের জন্য মানুষ অনেক আগে থেকেই সমুদ্রনির্ভর হয়েছে। সামুদ্রিক মাছ দেশের বাইরে রপ্তানি করে ও সামুদ্রিকা প্রাণী শিকার করে তা দেশের বাজারে বিভিন্ন উপকরণ বানিয়ে বিক্রি করে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা হচ্ছে। এখানেই ব্লু ইকোনমির ধারণা আরও জোরদার হচ্ছে। বর্তমান বিশে^ ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশে^র ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদ। ৩০ ভাগ জ্বালানি তেল ও গ্যাস আসছে সাগর থেকেই। এই বিশাল সমুদ্রে বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক শালিসি আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ যা আরেকটি বাংলাদেশের সমান। এরপর মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪১৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর থেকেই সমুদ্র ঘিরে স্বপ্ন গড়ে ওঠে। কাজও এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতিতে আরও সময় প্রয়োজন।
সমুদ্রের অফুরন্ত সম্পদ আহরণ করা উন্নত দেশ গড়তে একান্ত প্রয়োজন। এখান থেকে সি ফুডের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, বর্তমানে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রায় ৩০,০০০ মেট্রিক টন সি-ফুড বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশের সমুদ্র অর্থনীতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হলে আগামী ৫ বছর পর সি-ফুড রপ্তানি করে প্রতি অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে সি-ফুডের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তা ছাড়া পুষ্টির চাহিদা পূরণেও সি-ফুডের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ অংশই এই সুবিশাল সমুদ্র। আমাদের দেশের দক্ষিণে বিশাল সমুদ্র এলাকা ঘিরে এখন নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছে। সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে পাল্টে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র। এই নীল জলরাশির যে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে তা অনেকের কাছেই বহু বছর অজানা ছিল।
সমুদ্র ঘিরে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা ধারায় পরিবর্তন ঘটতে লাগল। সমুদ্র যে সম্পদে পরিপূর্ণ তা বুঝতে শিখল। অর্থনীতির উন্নয়নে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির যে ভূমিকা আছে এখন মানুষ তা জানে। আর জানে বলেই এক দেশ অন্য দেশের সঙ্গে সমুদ্রে আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ বা যুদ্ধ হুমকিতে জড়াচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। চীন বা জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো আরও দুই-তিনশ’ বছর আগে থেকেই সমুদ্রনির্ভর কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক দেশের সিংহভাগ জাতীয় আয়ই আসে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি থেকে। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের একটি বড় অংশই সমুদ্র থেকে আসে। যদিও উপকূল থেকে মাত্র ৫০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাছ ধরার সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের। সেই সঙ্গে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাও সমুদ্রের ওপরই স¤পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। বহু বছর ধরেই এসব জনগোষ্ঠী নৌকায়, ট্রলারে মাছ ধরে, জাল বুনে, মুক্তা ও চিংড়ি চাষ করে, লবণ শিল্প গড়ে তুলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা যদি আমাদের সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি, তা হলে দেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা এবং জাতীয় আয়কে আরও সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। সেভ আওয়ার সি এর তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পরে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। উপকূলীয় উঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলের জীবন-জীবিকার জোগান আসে সমুদ্র থেকেই।
মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে রহস্যময় এ বিশাল জলরাশির ভেতর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অফুরন্ত শক্তির উৎস।  জ্বালানি তেল, গ্যাস এসব প্রাকৃতিক সম্পদ পৃথিবীর ভূখণ্ডের থেকেও বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত রয়েছে সমুদ্র বক্ষের নিচে। রয়েছে বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্য, আগ্নেয়গিরি, পাহাড়-পর্বত। মানুষের চাহিদা মেটানোর সব উপকরণ সেখানে আছে। তথ্যানুযায়ী, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। তখন বিপুল এ জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিতে সমুদ্রের মুখাপেক্ষি হতেই হবে। বর্তমানে ৪শ ৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সমুদ্র। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। বিশ্বের সব দেশের নজর এখন সমুদ্রের দিকে। স্থল ও আকাশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সমুদ্রে সক্ষমতা প্রমাণে উঠে পড়ে লেগেছে সব দেশ। সামদ্রিক সীমানা নিজেদের দখলে রাখতে মোটা অঙ্কের বাজেট তৈরি করছে।
দেশের অর্থনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ বিনির্মানে সমুদ্রকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অধিকাংশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই ব্লু ইকোনমি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্থলভাগে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। তাই সমুদ্র এলাকায় গ্যাসের মজুত চিহ্নিত পূর্বক গ্যাস আহরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত আমাদের প্রধান বাধা। দেশের সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল এবং প্রযুক্তি না থাকায়, আমরা সেই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছি না। অথচ এই সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে বিশে^র অনেক দেশ আজ অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী। এক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও দায়ী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। 

×