ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কৃষি অর্থনীতি

ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ১৮:৫৬, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব

পহেলা অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনÑ অগ্র অর্থ ‘প্রথম’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। অনেকে এটিকে ‘আঘন’ মাস বলে থাকেন। গ্রামবাংলায় নানি-দাদিরা এ মাসকে আঘন মাস বা ধান কাটার মাস বলেন। এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে ঐতিহ্যবাহী এবং অসাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ। যদিও আকাশ সংস্কৃতির হাল আমলে অনেকটাই পাল্টে গেছে অগ্রহায়ণের চিরাচরিত সেই উৎসবের রীতি। যেন ভুলতে বসেছে আধুনিকমনস্ক কৃষক সমাজও। তথাপি কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার সরল জীবনযাপনের প্রতীক এই নবান্ন উৎসব একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বাঙালির জীবন থেকে। এখন সরকারি উদ্যোগে অগ্রহায়ণের এই আনন্দের দিনটি মহিমান্বিত করে রাখার উদ্যোগ হিসেবেÑ অগ্রহায়ণের প্রথম দিনটিকে জাতীয় কৃষি দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগের আয়োজনে সারাদেশেই পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস।
বাদশা আকবরের সময়ে পহেলা অগ্রহায়ণকে (মধ্য নভেম্বর) বাংলা নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সমস্ত দেশ শস্যে ছেয়ে যেত।  সে সময়ে বেশ জনপ্রিয় এবং ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন ফসল ছিল আউশ। অগ্রহায়ণের কিছুটা আগে মানে কার্তিক মাসে আউশ শস্যটি রোপণ করা হতো। যার ফলে হেমন্ত কাল এসে পৌঁছতেই শস্যের মাঠ হলুদে ছেয়ে যেত। হলুদ ফসলের মাঠ দেখে কৃষকের মুখে ফুটে উঠত তৃপ্তির হাসি। এ কারণেই সে সময়টাকে উৎসবে পরিণত করা হলো। নাম দেওয়া হয় ‘নবান্ন উৎসব’। নবান্ন উৎসব মানে ‘নতুন চাল বা অন্নের উৎসব’। এই সময় ধান কেটে শুকিয়ে সিদ্ধ করে তৈরি করা হতো নানা ধরনের পিঠাপুলি, পায়েস। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায় যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ মানে ‘নতুন অন্ন’। বাংলাদেশে নবান্ন শুরু হয় আমন ধান কাটার পর। আমনের নতুন ধানের চালের প্রথম রান্না কেন্দ্র করেই নবান্ন শব্দটির জনপ্রিয়তা। অঘ্রাণে নতুন ফসল পাকলে কৃষকরা ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালের এক কোণায় বেঁধে রাখেন। বাকি এই চালের পায়েসে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। এই নতুন চালের পায়েস দিয়ে মসজিদে দেওয়া হয় সিন্নি। এক সময় সাড়ম্বরে নবান্ন উদযাপন হতো। এই উৎসব মানুষের ভেতরে সমাদৃত ছিল অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে। কিন্তু কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব অনেকটা স্বকীয়তা হারিয়েছে। তবে এখনো বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু স্থানে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত ঘটা করে আনন্দ মুখর পরিবেশে উদ্যাপন হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উদ্যাপন শুরু হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। এ সময় অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষাণীর। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। যদিও যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামবাংলা। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চীন সম্রাট চিন সিং স্বয়ং মাঠে ধান বপন করে দেশব্যাপী একটি বার্ষিক উৎসবের প্রবর্তন করেন। জাপানে অতি প্রাচীনকাল থেকে সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে থাকে এবং এ উপলক্ষে জাতীয় ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। বঙ্গীয় এলাকায় আদিকাল থেকেই অনার্য বাঙালিরা নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করত। নানা আনুকূল্যে সে রেওয়াজ আজও চলে আসছে। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতায় অগ্রহায়ণ বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জন্ম তার, নাই যার চাষ।’ কবির অগ্রহায়ণ বন্দনার কারণ, যতদূর জানা যায়, অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ ছিল। ফলে এককালে নতুন ধানের মাস অগ্রহায়ণে বাংলা নতুন বছর শুরু হতো।
বাঙালির জাতীয় জীবনে স্মরণাতীত কাল থেকে পয়লা অগ্রহায়ণকে বিবেচনা করা হয় বছরের শুভদিন হিসেবে। এই নবান্নকেই আবার হেমন্তের প্রাণও বলা হয়। নবান্নের সঙ্গে বাংলার কৃষি ও কৃষক পরিবারের আনন্দ, আতিথেয়তার গভীর সম্পর্ক। কনের জামাতাকে নিমন্ত্রণ করা হয় নতুন ফসলের পিঠা-পুলি, পায়েস খাওয়ার জন্য। বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয় কন্যাকে। ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠাপুলি আর পায়েসের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। গ্রামের প্রায় ৬০ ভাগ লোকের জীবন-জীবিকা এখনো কৃষি ও খামারভিত্তিক। শহরেও শতকরা প্রায় ১১ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান শতকরা ১৫ দশমিক ৩৩ ভাগ। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান ৪৮ দশমিক ১ ভাগ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে ফসলি জমি কমার পরও কৃষি ক্ষেত্রে দেশের অকল্পনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছেÑ এটি খুবই আশার দিক। ১৯৭১ সালে যেখানে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন অসম্ভব হতো সেখানে জমি কমার পরও ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স¦য়ংসম্পূর্ণ। সরকারের বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের ধারাবাহিকতার ফলে কৃষি এখন শুধু ফসলের মাঠে নয়Ñ মৎস্য, গবাদিপশু পালন, সবজি ও ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ থেকে শুরু করে ব্যতিক্রম এবং নতুন নতুন কৃষিজ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও সাফল্য দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে আশার আলো দেখাচ্ছে। ধান, পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, শাক-সবজি, রকমারি ফল, সমুদ্র ও মিঠা পানির মাছ, গবাদিপশু, পোল্ট্রি মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকায় শীর্ষত্বের লড়াই করছে বাংলাদেশের কৃষি। কাজেই কৃষি এখন সামগ্রিক অগ্রগতির নাম। ফলে নবান্ন উৎসবের জন্য ইউনেস্কো স্বীকৃতির প্রচেষ্টা চালানো জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি।

×