যে কোনো বাজার অর্থনীতিতে পণ্য এবং পরিষেবার দাম পরিবর্তিত হতে পারে। দাম বৃদ্ধি পেতে পারে বা কমেও যেতে পারে। যা বাজার অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অর্থনীতির ভাষায়, একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে পণ্য বা সেবাসমূহের দাম বৃদ্ধি পেলে তাকে মূল্যস্ফীতি বলে। তাই সকল ধরনের মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক নয়। যেমন- ক্রিপিং ও ওয়াকিং ইনফ্লেশন অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু পণ্য বা সেবার দাম যখন অসহনীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি পায় তখন এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে দেশে পণ্য বা সেবার দাম অসহনীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ দিশেহারা। চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় পর্যায়ে সাধারাণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ ভাগ যা এই বছরের আগস্টে এসে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৪৯ ভাগ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ১১ দশমিক ৩৬ ভাগ।
২০২৪ এর সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি (৯ দশমিক ৬৩ ভাগ) ১০ ভাগের নিচে আসলেও কাঁচাবাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আগস্টের মতোই বিদ্যমান। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম একটি দায়িত্ব হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকার মূল্য সীমা, প্রাইস সিলিং বা প্রাইস ক্যাপ নির্ধারণ করতে পারে। যা ভোক্তাদের জন্য খরচ সীমিত করতে এবং মূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়ক হবে। সেই সঙ্গে বিক্রেতারা নির্ধারিত দামে পণ্য বা সেবাটি বিক্রি করছেন নাকি সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকার টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রির স্থান ও পরিধি বৃদ্ধি করতে পারেন। বর্তমানে দেখা যায় টিসিবি সাধারনত স্থায়ী বাজার থেকে অনেক দূরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পণ্য বিক্রি করে থাকেন। এতে নামমাত্র কিছু পরিবার সুবিধা পেয়ে থাকলেও বাজারে এর কোনা প্রভাব পড়ছে না। কিন্তু টিসিবি যদি স্থায়ী বাজারের ভেতরে বা সামনে বাজার চলাকালীন সম্পূর্ণ সময় তাদের পণ্য বিক্রি করতেন তাহলে পূর্ণ প্রতিযোগিতার বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন পক্ষের চাপ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার শক্ত হাতে প্রয়োগ করতে পারলে মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে জনসাধারণ রক্ষা পেত। তা ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর আমদানি শুল্ক স্বল্পমেয়াদে কমিয়ে বাজারে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে।
সরকারকে নিত্যপণ্য সামগ্রীর বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ ব্যবস্থা তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন ও তাদের কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রকাশ করতে হবে। সরকার বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করলেও তাদের কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি এখনও সমাজের চোখে প্রতীয়মান হয়নি। একইসঙ্গে সরকারকে যৌথবাহিনীর সহযোগিতায় সব ধরনের চাঁদাবাজি অতিসত্বর বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কমপক্ষে খাদ্যসংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। কারণ চাঁদাবাজি পণ্য ও সেবাসমূহের দামের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলে থাকে।
তা ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন বেসরকারি, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে পারে।
বেসরকারি, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিজ নিজ পরিধিতে ন্যায্য দামে পণ্য সরবরাহের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে পারে। সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি আজকাল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত। এই নীতির লক্ষ্য হলো সুদের হার বৃদ্ধি করে একটি অর্থনীতির মধ্যে অর্থ সরবরাহ হ্রাস করা। এটি ঋণের খরচ বাড়িয়ে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীর কাছে ঋণকে ব্যয়বহুল করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর করতে সাহায্য করে। আবার সরকারী সিকিউরিটিজের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ট্রেজারি কেনার জন্য উৎসাহিত করে প্রবৃদ্ধি মন্থর করে। রাজস্ব নীতির মাধ্যমেও সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিনসিয়ান অর্থনীতিবিদদের মতে, সামগ্রিক সরবরাহের তুলনায় সামগ্রিক চাহিদার আধিক্যের কারণে চাহিদা-টান মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। চাহিদা-টান মুদ্রাস্ফীতির পেছনে মূল কারন যদি সরকারি ব্যয় হয়, তবে সরকারি ব্যয় হ্রাস বা সরকারি অর্থের যথার্থ ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যয় বৃদ্ধির কারণে চাহিদা বৃদ্ধি পায়, সেক্ষেত্রে মুনাফা কর আরোপ করতে হবে। এটি সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস করতে ভূমিকা রাখে।
দীর্ঘমেয়াদে বাজারে চাহিদার তুলনায় অধিক পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।
এ ছাড়াও মূলধন, প্রশিক্ষণ, মানসম্পন্ন বীজ, সার এবং আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা প্রদান করে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে। কৃষকদের আরও বেশি উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে গড় আয় না কমিয়ে খামারের আয় স্থিতিশীল করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পরিবহন খরচ এবং পচনশীল পণ্যের ক্ষতি কমাতে গ্রামীণ অবকাঠামো যেমন গুদামঘর ও রাস্তা নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে। বর্তমানে কৃষকরা যে পরিমাণ সাহায্য ও সহযোগিতা পাচ্ছেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কৃষি কাজ লাভজনক নয় বিধায়, বর্তমানে অনেক কৃষক বাপ-দাদার কৃষি কাজ ছেড়ে অন্য কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছেন, যা ভবিষ্যতের জন্য কোনো সুখবর নয়।
সরকার দীর্ঘমেয়াদে প্রতিটি জেলা ও থানা পর্যায়ের কাঁচাবাজারে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থায়ীভাবে দৈনন্দিন জিনিসপত্র ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারে। পূর্ণ প্রতিযোগিতার বাজারে তখন অন্যান্য ব্যবসায়ী তাদের নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সরকারের নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে আগ্রহী হবেন। এটি করা সম্ভব হলে, সরকারকে অন্যান্য ব্যবসায়ীর তদারকির পেছনে অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হবে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যে দাম বাড়ানো হয়, তা অনেকাংশে কমে যাবে।
পরিশেষে, কোনো সরকারকে এককভাবে দায়ী না করে, আমরা সবাই যদি আমাদের দায়িত্বগুলো নিষ্ঠা, সততা এবং জবাবদিহিতার সঙ্গে পালন করতে পারি, তবে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয়
শীর্ষ সংবাদ: