.
শেয়ারবাজারের একটি আলোচিত নাম জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেন। যিনি শুধু দুর্বল কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করে শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করেন। তালিকাভুক্তির কিছুদিন পরেই কোম্পানিগুলো রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তালিকাভুক্তির পর কোম্পানির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেই অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে থেকেই তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। উল্টোদিকে তার মালিকানাধীন কোম্পানি জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিকরা বেতন পান না তিন মাস ধরে। হঠাৎ করেই জাভেদ যুক্তরাজ্যে গিয়ে আর ফিরে না আসায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে শেয়ারবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্তি, অধিগ্রহণ এবং অন্যদের শেয়ার ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে নিজের নামে নেওয়ার মতো হাজারও অভিযোগ রয়েছে জাভেদের বিরুদ্ধে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চুপ ছিলেন। সেই সুযোগে শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন তিনি।
সর্বশেষ তিনি এসএস স্টিল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেন। তালিকাভুক্তির পর ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেন এসএস স্টিলের কৃত্রিম মুনাফা দেখানোর জালিয়াতি করতেও দ্বিধা করেন তিনি। কারণ তিনি জানতেন, মুনাফা দেখানো না হলে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাবে না। এছাড়া যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়েও তৈরি হবে জটিলতা। এতে করে পুরো বন্ধ হয়ে যাবে কোম্পানি। ফলে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাও নেওয়া সম্ভব হবে না। এই বিষয়ে এসএস স্টিলের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, এসএস স্টিলের নামে ঋণ নেওয়ার জন্য এমন কোনো ভুয়া তথ্য নেই, যা কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে দেখানো নাই। মুনাফা দেখাতে সর্বোচ্চ জালিয়াতি করা হয়েছে। জালিয়াতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিক্রি বেশি করে দেখিয়ে কৃত্রিম মুনাফা। প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিটি লোকসানে রয়েছে। কিন্তু লোকসান দেখালে ঋণ পাওয়া যাবে না। তাই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ঋণ নেওয়ার জন্য ভুয়া মুনাফা দেখিয়ে আসছে এখন পর্যন্ত।
এসএস স্টিলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঋণ নিয়ে অনিয়মের মধ্যে থাকা জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন ঋণ নেওয়া এবং টাকা পাচারের ক্ষেত্রে। জাভেদ এই ক্ষেত্রে তার সৎমা সেই সময়ে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দা মুনার নাম ব্যবহার করেছেন।
জানা গেছে, জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেন জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনকে প্রথমে শেয়ারবাজারে আনেন। এরপরে তালিকাভুক্ত করেন এসএস স্টিলকে। যিনি জেনারেশন নেক্সটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরে কোম্পানিটি থেকে বেরিয়ে গেছেন। যে কোম্পানিটি এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে। আইপিওকালীন জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ছিলেন জাভেদ অপগেনহ্যাপেন। আইপিওকালীন কোম্পানিটিতে তার ৯৩ লাখ ১০ হাজার বা ১০.৬৮ শতাংশ শেয়ার ছিল। যিনি এই শেয়ারের উপর ২০১১ ও ১২ সালে ২০ শতাংশ করে ৪০ শতাংশ বোনাস শেয়ার নেন। যা ২০১৩ সালে রাইট শেয়ারের আবেদনের আগেই বিক্রয় করে দেন। এছাড়া পরবর্তীতে প্রাপ্ত বোনাস শেয়ারসহ সব বিক্রয় করে দিয়েছেন। এরপরে জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেন শেয়ারবাজারে আনেন এসএস স্টিল। দুর্বল এ কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে তিনি শেয়ার ও নগদ অর্থ লেনদেন করেন। যে কোম্পানিও এখন দুর্বল। তবে কোম্পানির নামে আছে হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ।
জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেনের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে নানা কারসাজি, জালিয়াতিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একাধিক ঘটনায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তার নিজের ও কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
বর্তমানে প্রকৌশল খাতের এস এস স্টিল নামের কোম্পানিটি ভুয়া প্লেসমেন্টের মাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনা হয়েছিল। ২০২০ সালে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্লেসমেন্ট ইস্যু করা ১ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ উঠলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ওই শেয়ার ফ্রিজ করে দেয়।
২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এসএস স্টিলের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বা ৩টি প্রান্তিকে ১০ টাকার অভিহিত মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ০.১২ টাকা।
অন্যদিকে ৩২৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এসএস স্টিলের সমন্বিত হিসাবে (সাবসিডিয়ারিসহ) ১ হাজার ৭০৫ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৬৯৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। যে কোম্পানিটির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে মোট ঋণ ছিল ৯৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ঋণ বেড়েছে ৭২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ কোম্পানিটির গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এরপরে গত ৩১ ডিসেম্বর বেড়ে হয় ১ হাজার ৫৮৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
জাভেদ অপগ্যানহ্যাপেন ঋণ নিয়ে অর্থ পাচারের পাশাপাশি এরই মধ্যে যাচাই-বাছাই ছাড়াই এসএস স্টিলের নামে কয়েকটি স্টিল কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছেন। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফুওয়াং সিরামিক ও ওয়াইম্যাক্স ইলেকট্রেডস অধিগ্রহণ করেন। আর আজিজ পাইপস অধিগ্রহণের চেষ্টা করছেন। এই অধিগ্রহণের সময়ও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
এই বিষয়ে এসএস স্টিলের কোম্পানি সেক্রেটারি সাজ্জাদ রহমানের কাছে বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে। তার প্রমাণ দিতে হবে। প্রমাণপত্র দেখে এই সংক্রান্ত বক্তব্য দেওয়া হবে।