দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতিতে আবারও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি
দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতিতে আবারও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি উভয়ই বেড়েছে। বিশেষ করে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও অক্টোবরে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। অক্টোবর মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যা সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ আর গত আগস্টে মাসে ছিল ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অন্যদিকে সেপ্টেম্বরের এক অঙ্কের তুলনায় গত মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে দুই অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলছেন, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম আছে। ডলার রেট বর্তমানে স্থিতিশীল আছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য।
দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের দুর্ভোগ কমছেই না। বিশেষত, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। ফলে খাদ্যপণ্য নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে দেশের মানুষ। অক্টোবরের তথ্যানুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে ১০০ টাকার খাদ্যপণ্যে ১২ টাকা ৬৬ পয়সা বাড়তি খরচ করতে হয়েছে ভোক্তাদের। অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ হয়েছে। যা সেপ্টেম্বরে এক অঙ্কে নেমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ আর তার আগের মাস আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি নিয়ে চলতি বছরের অক্টোবর মাসের ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে। বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাক জাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরের সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে সাধারণ বা গড় মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, গত মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। অক্টোবরে বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন ও শিক্ষা উপকরণের দাম কিছুটা কমেছে। মাসটিতে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে গত জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে দেশে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়। রাজধানী ঢাকা কার্যত সারাদেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্থবিরতা নামে পণ্য সরবরাহে। এরই প্রভাবে জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। দেশের ইতিহাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির এ হার অতীতে আর দেখা যায়নি।
এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়েছিল, যা গত ১২ বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে খাদ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যায় ২০১১ সালের অক্টোবরে ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ফলে অক্টোবর মাসে সাধারণ খাত ও খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস)-এর সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত সাংবাদিকদের বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে মূল্যস্ফীতি বাড়ে-কমে। সরকার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। কিন্তু সরবরাহ স্বাভাবিক করতে পারছে না। এ কারণে মূল্যস্ফীতি আবারও বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিতে সরবরাহ বাড়াতে হলে শুল্ক কমিয়ে আমদানি বাড়াতে হবে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
আর গত জুলাইয়ে দেশে জাতীয় পর্যায়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হারে।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে কারসাজি করা হতো বলে প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। জনগণের সামনে অসাধারণ অর্থনৈতিক পারফরর্মেন্স তুলে ধরে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়াতেই এসব করা হতো বলে জানিয়েছে কমিটি। তারা বলেন, শেখ হাসিনার আমলে বিবিএস প্রথমে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রস্তুত করে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে জমা দিত। পরিকল্পনামন্ত্রী নিজের ইচ্ছামতো কমিয়ে আনার নির্দেশ দিতেন। তার পছন্দমতো তথ্য সাজিয়ে পাঠালে তা অনুমোদন করতেন মন্ত্রী।
পরে তা অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হতো। তিনি আরেক দফায় তা কমিয়ে অনুমোদন করতেন। আর হাসিনা যে তথ্য অনুমোদন দিতেন, বিবিএস সেটিই প্রকাশ করতে বাধ্য হতো।
মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি হলে বা বেশি হলে পরিকল্পনামন্ত্রীরা তা কোনোমতেই অনুমোদন করতেন না, বরং অনেকটাই কমিয়ে দিতেন তারা জানান জাতীয় শ্বেতপত্র কমিটির একজন সদস্য।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ জানালেন গভর্নর ॥ অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশ ছাড়ালেও এটাকে অস্বাভাবিক কিছু নয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মূলত বন্যার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। গভর্নর বলেন, গত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি জোর করে কমিয়ে রাখা হতো। কিন্তু জুলাইয়ের পর থেকে এটা ফ্রি। যার কারণে সঠিক তথ্যই ওঠে আসছে।
মূলত গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যার প্রভাবে অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে জানিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তিনি বলেন, ‘পণ্যের দাম কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সময় লাগবে। ৭ বছর ধরে বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করেই কমানো যাবে না। মানুষকে ধৈর্য ধরতে হবে।’ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডলার রেট বর্তমানে স্থিতিশীল আছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য।