ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বকেয়া ৫০ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ৫ নভেম্বর ২০২৪

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বকেয়া ৫০ হাজার কোটি টাকা

.

বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে সরকারের বকেয়া রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে গতবছরের আগস্ট থেকে এবছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎখাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা এখাতে চলতি অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের চেয়েও ৩০ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা।
প্রতিমাসে বিদ্যুৎখাতে সরকারের বকেয়া হিসাবে ৩,৫০০-৪,০০০ কোটি টাকা নতুন করে যুক্ত হলেও - রাজস্ব আহরণ কম হওয়ায়, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে পরিশোধ করতে পারছে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ কোটি টাকা। ফলে বকেয়ার পরিমাণ দিন দিন আরও বাড়ছে বলে জানা গেছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধের অংশ হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড জারির পরিকল্পনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা অন্তত কিছু বকেয়ার চাপ কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় অংকের বকেয়া রয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের, যার পরিমাণ (৮৪০ মিলিয়ন) ৮ কোটি ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে আদানির বকেয়া পরিশোধে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কোম্পানিটির ২০৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। এরমধ্যে গত মাসে ৯৭ মিলিয়ন ডলার ও চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম চার দিনে ১০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।

তারপরও আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সরকারের কিছু করার নেই বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের অনেকগুলো উৎসের একটা হচ্ছে আদানি পাওয়ার, আর বর্তমান সরকার এসব সরবরাহকারীকে বিশেষ কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেনি। জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আগামী দুই বছরের মধ্যে জ্বালানিখাতের বকেয়া বিল শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পেট্রোবাংলা ও বিপিসি প্রতিমাসের বিলের সমপরিমাণের তুলনায়- বাড়তি কিছু অর্থ পরিশোধ করছে পাওনাদারদের। কিন্তু, রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎখাতের বকেয়া কমানোর একইরকম কোনো পরিকল্পনা করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগ। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধের জন্য গতমাসে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে, যা দিয়ে গত অর্থবছরের আগস্ট মাসের বকেয়ার কিছু অংশ পরিশোধ হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও- রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ার কারণে পুরোটা ছাড় করতে পারবে না অর্থ মন্ত্রণালয়। পুরো অর্থবছরে ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। বাকিটা বকেয়াই থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বিদ্যুৎখাতের বকেয়ার যে পাহাড় জমেছে যা খুবই বাজে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বকেয়া ভর্তুকি কমাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে অর্থ সাশ্রয় করে এখাতে দেওয়া যেতে পারে। আবার বিদ্যুৎখাতে যথেষ্ট অপচয়, অপব্যয় ও দুর্নীতি আছে, সেগুলো কমাতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো না, মূল্যস্ফীতিও অনেক বেশি। তাই বকেয়ার চাপ কমাতে- কোনোমতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত হবে না। বরং রাজস্ব আহরণ বাড়াতে জোর দিতে হবে- তিনি যোগ করেন।
বকেয়া কমানোর পরিকল্পনা ॥  বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধের অংশ হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়,  ইতোমধ্যে যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্রই এই বন্ড ইস্যু করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিদ্যুৎখাতের বকেয়া পরিশোধের জন্য গত অর্থবছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু, কম সুদের এসব বন্ড নিতে আগ্রহী হয় না ব্যাংকগুলো। কারণ অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হবে। এ ছাড়া, বাজেট থেকে প্রতি মাসে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ কোটি টাকা ছাড় করা হবে।
অন্যদিকে, শেভরনের সরবরাহ করা গ্যাসের বিলসহ এলএনজি আমদানি ও জ্বালানি তেল আমদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ডলার, টাকার অংকের যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি তেল আমদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার, শেভরনের পাওনা ১২০ মিলিয়ন ডলার ও এলএনজি আমদানির বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলার। কর্মকর্তারা বলেন, এসব দেনা কমাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে শেভরনের বকেয়া পরিশোধ বাড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছে, তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে   বৈদেশিক দেনা ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার। সেটা কমে বর্তমানে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে প্রভাবিত না করে- আমরা বকেয়া পরিশোধ করব। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় করা হয়েছে। এখন বকেয়া পরিশোধে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে, সেটা রিজার্ভ থেকে নয়। এটাও সবাইকে বিচার করতে হবে যে, বৈদেশিক মুদ্রার উৎস রপ্তানি, রেমিটেন্স রাতারাতি বাড়িয়ে ফেলা যাবে না। এ সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমরা পাওনাদারদের দিচ্ছি।

×