গেটাচিউ মেনগিস্টি
একটি এয়ারলাইন্স টিকে থাকা না থাকা কিংবা লাভ লোকসান নির্ভর করে ফ্লাইটের সেফটি, সিকিউরিটি ও সার্ভিসের যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সেবার ওপর। এ তিনটি বিষয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেকখানি ভূমিকা রাখতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশের সিভিল এভিয়েশনের নীতিমালা। এ নীতি অনুসরণ করেই বিশ্বব্যাপী সুনাম ও মর্যাদা কুড়িয়েছে ইথিওপিয়া এয়ারলাইন্স।
বিশ্বব্যাপী এভিয়েশন শিল্পের বিকাশ নিয়ে এমন মতামতই প্রকাশ করেছেন ইথিওপিয়ান সিভিল এভিয়েশন অথরিটির মহাপরিচালক গেটাচিউ মেনগিস্টি আলেমায়েহু।
বর্তমানে ঢাকায় সফররত গেটাচিউ এক সাক্ষাৎকারে দৈনিক জনকণ্ঠকে বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেন। গুলশানে ইথিওপিয়া এয়ারের জিএসএ রিদম গ্রুপের অফিসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দুদেশের বর্তমান এভিয়েশনের হালচাল নিয়ে কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহাগ হাসান ও ইথিওপিয়া এয়ারের সিইও সলোমন বেকেল।
গেটাচিউ মেনগিস্টি আলেমায়েহু মনে করেন, একটি দেশের এভিয়েশন খাতের উন্নয়ন নির্ভর করে দেশটির সিভিল এভিয়েশন অথরিটির নীতিমালা কতটা নমনীয় তার ওপর। দেশের এভিয়েশন খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) খুবই ভালো কাজ করছে। তবে তাদের বিমান পরিবহন নীতিমালা আরও উদার হতে পারে। এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ যত বেশি সহায়ক শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে, ওই দেশের এয়ারলাইন্স তত বেশি উন্নতি করবে। বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত।
একটি দেশের এভিয়েশন খাতকে এগিয়ে নিতে দেশটির সিভিল এভিয়েশনের নীতিমালা কেমন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বেবিচকের সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। বেবিচক খুবই ভালো কাজ করছে। তবে আরও ভালো করার সুযোগ সবসময়ই থেকে যায়। সেক্ষেত্রে বিমান পরিবহন নীতি আরও উদার হতে পারে। এতে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবসা আরও সমৃদ্ধ হবে, একইভাবে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহ বাড়বে।
বর্তমানে বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যেই দেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি যতো বেশি শক্তিশালী ও উদার সেদেশের এয়ারলাইন্স তত বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। এমন তাগিদ থেকেই ইথিওপিয়ায় খুবই স্ট্রং এভিয়েশন ট্রেনিং একাডেমি রয়েছে, সিমুলেটর রয়েছে। সারাবিশ্ব থেকে অনেকে আসে এখানে ট্রেনিং নিতে। আমরা বাংলাদেশী পাইলটদের ট্রেনিং দেওয়ার বিষয়ে ভাবছি। আমরা ইতোমধ্যে বেবিচকের সঙ্গে কথা বলেছি। বাংলাদেশে ফ্লাইট বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ঢাকা রুটে সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট চালাচ্ছি। যাত্রীদের ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি।
তাছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোতে ২৫ লাখের মতো বাংলাদেশী থাকে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি ওমরাহ হজে যায়। আমরাও ওমরাহযাত্রী বহন করতে আগ্রহী। যাত্রীদের এই সাড়া অব্যাহত থাকলে আমরা শীঘ্রই সপ্তাহে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করতে চাই।
ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বহরে বর্তমানে ১৫২টি বিমান রয়েছে। অর্থনীতির মানদ-ে স্বল্পোন্নত দেশের একটি এয়ারলাইন্স আফ্রিকার সর্ববৃহৎ বহরের অধিকারী কীভাবে হলো? জানতে চাইলে গেটাচিউ মেনগিস্টি আলেমায়েহু বলেন, ইথিওপিয়ার এভিয়েশন খাত নব্বই দশকের দিকে আত্মপ্রকাশ করে। সে সময় বিশ্বের খুব অল্প দেশেই এই খাত জনপ্রিয় ছিল। ফ্লাইটের সেফটি ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করার কারণেই ইথিওপিয়ায় এই শিল্পটি এতদূর এগিয়েছে।
বাংলাদেশ সফরকালে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা করে আলাপ করেছেন ইথিওপিয়ান সিভিল এভিয়েশন ডিজি। আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে মেনগিস্টি জানান, দুই দেশের বিমান পরিবহন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমর উভয়ই বিমান চলাচল ও সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করি। ইথিওপিয়ায় এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রদানের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাইলটসহ এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা এখানে এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
আমরা বাংলাদেশের পাইলটসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছি। এছাড়াও অডিট ইন্সপেকশন, পারস্পারিক দক্ষ অডিটর বিনিময়, বাংলাদেশ রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং একাডেমিক সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) সম্পাদনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়। আফ্রিকা থেকে ঢাকায় এলো ইথিওপিয়ান...‘ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বহরে ২০টি বোয়িং ৭৩৭-ম্যাক্স এয়ারক্রাফট রয়েছে। ম্যাক্স সিরিজের এই বিমানটি দিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন, লায়ন এয়ার ও ইথিওপিয়ান এয়ার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বিশ্বের অনেক দেশ এই এয়ারক্রাফট গ্রাউন্ডেড করে দেয়। এমনকি দুর্ঘটনার কারণে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন, লায়ন এয়ারের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে দুর্ঘটনার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ফ্লাইট পরিচালনার আগে যাত্রীর ফ্লাইট সেফটি ও সিকিউরিটির দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনার পর অধিকতর তদন্ত হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্ঘটনার কারণ এয়ারলাইন্স, পাইলট বা সংশ্লিষ্ট কেউ নন। তারপরও আমরা ত্রুটি সারিয়ে, নতুন ও রিভাইজড ৭৩৭-ম্যাক্স গ্রহণ করি। এরপরই শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ম্যাক্স দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করি।
এ সময় জানতে ইথিওপিয়ান এয়ারের সিইও সলোমন বেকেলের কাছে আগামীদিনের সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, গত সোমবার সকালে ঢাকা থেকে আফ্রিকার লুগাই আদ্দিস আবাবায় সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়ে। এই রুটে বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফট দিয়ে বর্তমানে সপ্তাহে ৫টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। এই ফ্লাইট চালুর মাধ্যমে দুই দেশের সুসম্পর্ক নতুন মাত্রা পেল। ফ্লাইট চালুর ফলে দু-দেশের আমদানি-রপ্তানি আরও সহজতর হবে। আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতেও বাংলাদেশীদের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্প অনেক বড় ও স্বনামধন্য। আমরা এসব সেক্টরের ব্যবসায়ীদের নিয়ে ইথিওপিয়ায় বিজনেস কমিউনিটি করতে চাই।
আফ্রিকান এয়ারলাইন্স হিসেবে ইথিওপিয়ান এয়ার কি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশী যাত্রী বহনে মধ্যপ্রাচ্যের বিমানগুলোর একক আধিপত্যে ইথিওপিয়া টিকতে পারবে কি না, জানতে চাইলে সলোমন বেকেল বলেন, আমরা বিভিন্ন রুটেও টার্কিশ এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস এয়ারলাইন্স, সৌদি অ্যারাবিয়া এয়ারলাইন্সের সঙ্গে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা করে ফ্লাইট পরিচালনা করছি। এটা নতুন কিছু না। আমরা জানি কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হয়। আমরা আমাদের সেবা ও ফ্লাইট সেফটি নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। আমরা প্রতিযোগিতার কৌশল জেনেই ঢাকায় ফ্লাইট শুরু করেছি।
পাশাপাশি ঢাকায় আমাদের একটি ডায়নামিক টিম কাজ করছে। আমরা যাত্রীদের জন্য সহনীয় টিকিটের দাম রাখতে চাই, অতিরিক্ত ব্যাগেজ ও সেরা সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজার ধরতে চাই। এভিয়েশন শিল্প ছাড়া আর কিভাবে ইথিওপিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই দুদেশের অনেক সুন্দর ও সম্ভাবনাময় টুরিস্ট স্পট রয়েছে, যেগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে বিকশিত করা সম্ভব।
