ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১

উন্নয়ন প্রকল্প কমেছে

ত্রিমুখী চাপে রড-সিমেন্ট খাত, লোকসানে বিক্রি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:১৩, ৩ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ০০:২০, ৩ নভেম্বর ২০২৪

ত্রিমুখী চাপে রড-সিমেন্ট খাত, লোকসানে বিক্রি

ত্রিমুখী চাপে রড-সিমেন্ট খাত

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কয়েক বছর ধরে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ধীরগতি চলছে। এ কারণে মন্দা কাটছে না দেশের রড-সিমেন্ট খাতে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মেগা প্রকল্পগুলোয় আরও ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এতে রড-সিমেন্ট খাতের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

রড-সিমেন্টের চাহিদা হ্রাস, উৎপাদন খরচ ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি- এই ত্রিমুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই খাত। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুই মাসে কোম্পানি ভেদে ইস্পাতের বিক্রি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। পাশাপাশি সিমেন্টের বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করছেন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ থাকাকে। কারণ দেশের মোট ১ লাখ ২০ হাজার টন উৎপাদিত ইস্পাতের প্রায় ৬৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সরকারি প্রকল্পে।

‘রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নাজুক ইস্পাত খাতের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তাই বাধ্য হচ্ছি উৎপাদন কমিয়ে আনতে।’-বিএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত। ব্যবসায়ীদের সূত্র মতে, গত দুই মাসে রডের চাহিদা কমার কারণে প্রতি টনে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা দাম কমেছে। ফলে পণ্যের মজুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইস্পাত কারখানার উদ্যোক্তারা জানান, সংকট কাটিয়ে বাজার ভালো হবে, এমন আশায় প্রায় সবাই চাহিদা কমের মধ্যেও বাড়তি উৎপাদন করেছিলেন। এখন বিক্রি কমে কারখানা ও গুদামে রডের স্তূপ জমেছে। বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। এতে আবার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসার মূলধন জোগাড় করতে প্রতি টনে উৎপাদন খরচের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লোকসানে রড বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এই সংকট নিরসনে শিল্প উদ্যোক্তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পুনরায় চালু করা এবং শিল্পের কাঁচামালের আমদানিতে শুল্ক কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘বিগত সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্টিল উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব উন্নয়ন কর্মকা- বন্ধ। সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ায় ঠিকাদাররা মালের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে আমাদের লোকসান হচ্ছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের অনেকে গাঢাকা দিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নাজুক ইস্পাত খাতের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তাই বাধ্য হচ্ছি উৎপাদন কমিয়ে আনতে।
ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সংশোধন চান আবাসন ব্যবসায়ীরা বিএসআরএম গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, গ্রুপটির বার্ষিক রড উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৮ লাখ টন। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বিএসআরএম মেল্টিং ইউনিটের চারটি মডিউলের মধ্যে মাত্র দুটি মডিউলে উৎপাদন চলছে।
রানী রি-রোলিং স্টিল মিলসের নির্বাহী পরিচালক সুমন চৌধুরী বলেন, ‘বিগত সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্টিল উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব উন্নয়ন কর্মকা- বন্ধ। সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ায় ঠিকাদাররা মালের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে আমাদের লোকসান হচ্ছে। ‘আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৯০ শতাংশ থেকে কমে এখন ৩০-৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মুনাফা তো দূরের কথা, আমরা কারখানাই চালাতে পারছি না। আমাদের এক টন রড উৎপাদন করতে খরচ হয় ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু ১০-১৫ হাজার টাকা লোকসানে তা বিক্রি করছি।

রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা মো. মাহবুবুর রহমান একজন সরকারি চাকরিজীবী। এই বছর মার্চে বাড়ির কাজ শুরু করেছেন। তিনি জানান, গত মার্চ মাসে বাড়ির কাজ শুরুর সময় রড কিনেছিলেন প্রতি কেজি ৯১ টাকা। একই রড তিনি অক্টোবরে কিনেছেন প্রতি কেজি ৮৩ টাকা। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক কারখানার মালিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিফট কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। তিন শিফটের পরিবর্তে দুই শিফটে কারখানা চালাচ্ছেন এবং সপ্তাহে একদিনের বদলে দুদিন কারখানা বন্ধ রাখছেন।

রড প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমানে ৭৫ গ্রেড অটোমেটিক এমএস রড কারখানা পর্যায়ে প্রতি টন ৮৬-৮৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুই মাস আগে ছিল ৯২-৯৪ হাজার টাকা। ৬০ গ্রেড সেমি-অটোমেটিক রডের দাম দুই মাস আগে ছিল প্রতি টন ৮৬-৮৮ হাজার টাকা। এখন তা প্রতি টন ৭৮ থেকে ৮১ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২০০টি ইস্পাত এবং রি-রোলিং কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন করে বড় ৪০টি কোম্পানি। এই খাতের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১ কোটি ২০ লাখ টন; যদিও দেশের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন।

বিএসএমএর সাধারণ সম্পাদক সুমন চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের ইস্পাত শিল্পের বয়স প্রায় ৭০-৭২ বছর। আগে ইস্পাত আমদানি করতে হতো, কিন্তু এখন আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইস্পাত রপ্তানি করছি।
কিন্তু বর্তমানে এ খাত অনেক ক্ষতির কবলে আছে। একদিকে চাহিদা কম, তার ওপর উৎপাদন খরচ বেশি, আবার কাঁচামালের দামও বেশি। সার্বিকভাবে আমরা ত্রিমুখী সমস্যার মধ্যে আছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পুনরায় চালু করা এবং শিল্পের কাঁচামালের আমদানিতে শুল্ক কমানোর আহ্বান জানাই।’ যোগ করেন সুমন চৌধুরী।

একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশের সিমেন্ট খাতেও। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সিমেন্টের চাহিদা ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে। এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাকারিয়া জানান, সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হয়। কিন্তু গত দুই মাসে বিক্রি এতটাই কমেছে যে এখন প্রতিদিন গড়ে মাত্র ২০০-২৫০ বস্তা বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্যমতে, দেশে ৪০টি সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকটি একই গ্রুপের অধীনে পরিচালিত হয়। দেশের বার্ষিক প্রায় চার কোটি টন চাহিদার বিপরীতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাত-আট লাখ কোটি টন।

বিসিএমএর নির্বাহী পরিচালক সংকর রায় বলেন, চাহিদা কমে গেছে কিন্তু আমাদের উৎপাদন আগের মতোই আছে। এই শিল্প শতভাগ আমদানিনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যেখানে আমাদের প্রতি বছর ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় সেখানে চার মাস ধরে ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

রাজু

×