আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায়
জীবজগত টিকে থাকার জন্য অন্যতম নিয়ামক হলো সমবায়। আর সমবায়ী মনোভাব যেখানে অনুপস্থিত, সেখানেই বিশ্ঙ্খৃলা এবং এর ফলশ্রুতিতে মূল উদ্দেশ্য গতিহারা হয়ে মাঝ পথেই ভরাডুবি হয়ে থাকে, যার ভূরি ভূরি উদাহরণ বাস্তবে পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কতিপয় লোকের সংঘবদ্ধ হওয়ার পদ্ধতিকে ‘সমবায়’ ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। আর মানবজীবনে এই সম্মিলিত প্রয়াস বয়ে আনে বিপুল সম্ভাবনা।
সাধারণত যেখানে একক প্রচেষ্টায় কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করা সম্ভবপর হয় না; সেক্ষেত্রে সমবেত প্রচেষ্টার আবশ্যকতা দেখা দেয়। আর সকলে সম্মিলিতভাবে যে কাজটি যত সহজে সম্পাদন করতে পারে, পৃথক পৃথকভাবে তথা এককভাবে তা বাস্তবায়িত করা ততটা সহজ নয়। সকলে মিলে কাজ করতে পারলে, তাতে সাফল্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কালভার্টের মতে, “কিছু সংখ্যক লোক যখন কোনো অর্থনৈতিক স্বার্থ সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় সম্মিলিত হয়, তখন তাকে ‘সমবায়’ বলা হয়।” আর এর ওপর ভিত্তি করেই সমবায় আন্দোলনের উদ্ভব এবং কালক্রমে বিকাশ সাধিত হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ইংল্যান্ডের রচডেল গ্রামের প্রথম সফল সমবায় সমিতির কথা হয়তো অনেকেই জানেন এবং বলতে গেলে সেখানেই অংকুরোদগম হয়। এদিকে সমবায় আন্দোলনের ক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এক্ষেত্রে যে পুরোধার কথা উঠে আসে; তিনি হলেন অর্থনীতিবিদ রাইফিজেন। এই মহান-হৃদয়বান জার্মান সমাজ-সংস্কারক মহাজনদের নির্মম শোষণ থেকে কৃষককুলকে রক্ষার জন্য সমবায় আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।
আর সেই থেকে সমবায়ী ধারা সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। আর আমাদের এই উপমহাদেশে উইলিয়াম নিকলসন সমবায়ের নীতি গ্রহণ করেন এবং একটি ঋণদান সমিতি আইন পাস করেন। আর এই আইনের ভিত্তিতে শহরে-গ্রামে-বন্দরে কৃষক, কারিগর ও স্বল্পবিত্ত মানুষের মধ্যে সমবায়িক কর্মপ্রচেষ্টা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৪ সালে কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ অ্যাক্ট পাস করে সমবায়ী কার্যক্রম শুরু করা হয়।
শুধু তাই নয়, সমবায় আন্দোলনকে ব্যাপকতর করার জন্যে ১৯১২ সালে নতুন কো-অপারেটিভ অ্যাক্ট জারি করা হয় এবং এই আইনে ঋণদান সমিতি ব্যতীত ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কার্যরত অনুরূপ সমিতিগুলোকেও সমবায় সমিতিরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই সময় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সমবায় ব্যাংক স্থাপন করা হয়। ১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে সমবায়কে পুরোপুরি প্রাদেশিক সরকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সময়ের পরিক্রমায় দিনের পর দিন এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তান আমল এসে যায়। সেই সময়ে সমবায় কৃষি ব্যাংক, সমবায় বীমা সমিতি, সমবায় ঋণদান সংস্থা, বিক্রেতা সমবায় সমিতি, ইত্যাদি গড়ে ওঠে। তবে তখন সরকারি কার্যোদ্যোগের অভাবে জনগণের মধ্যে সমবায় আন্দোলনের ভিত মজবুত না হলেও এর প্রসার ঘটেছিল। তৎপর বাংলাদেশে এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রসার লাভ করে।
দুঃখের বিষয় হলো যে বিগত প্রায় দেড়যুগ অগণতান্ত্রিক পরিবেশে অনেক লম্বা লম্বা কথা বলা হলেও, বাস্তবে আমরা এক্ষেত্রে অনেকাংশে পিছিয়ে ছিলাম। দেশে খেয়াল খুশি মতো সিদ্ধান্ত ও নৈরাজ্যের জন্য সমবায়সহ অনেক সেক্টর বলতে গেলে থমকে দাঁড়িয়েছিল। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি কৃষিনির্ভর দেশ। সবে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে, কাজেই বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি পশ্চাৎপদ দেশের পক্ষে সমবায় নীতি খুবই ফলপ্রসূ ও কার্যকর ব্যবস্থা।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে, বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে সমবায়ের প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের দরিদ্র, অসহায় কৃষককুল সারাদিন প্রাণপাত পরিশ্রম করে তাদের ক্ষুধার অন্ন সংগ্রহ করতে পারেন না। তদুপরি ঋণভারে তারা জর্জরিত। কৃষি জমি পুরুষানুক্রমে খ-িকৃত হয়ে আসছে। হাড়ভাঙা খাটুনির ফসল মহাজনের গোলায় ওঠে ঋণের দায়ে। কৃষিজাতপণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও ত্রুটিপূর্ণ। সত্যিকারার্থে যে দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল, সে দেশে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
কেননা সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত বীজ, সার ইত্যাদি প্রয়োগের দ্বারা চাষাবাদে অধিক ফসল উৎপন্ন করা সম্ভব। তাই বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন জনপ্রিয় করে সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত ধরনের বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ, কুটিরশিল্পের প্রসার, মূলধন সংগ্রহ, কাঁচামাল সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বিক্রি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমবায়ের প্রয়োগ অপরিহার্য। সমবায় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুক্তিদাতা। আর সমবায়ের পরিধি ছোট থেকে অনেক বড় হতে পারে। আদর্শ সমবায় সংগঠন সমাজের অবকাঠামোর পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দান করে।
বস্তুত সমবায় গড়ে ওঠে কতিপয় মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে, যেমন- সহযোগিতামূলক মনোভাব, একতা, সাম্য, সততা, নৈকট্য, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মিতব্যয়িতা, ঐক্যমত্ততা, স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা, বিশ^স্ততা, সম্প্রীতি, বিশ^াস ইত্যাদি। মূলত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ ও সমাজে কল্যাণ সাধনই এর মূলমন্ত্র।
পূর্বেই কিছুটা আলোকপাত করলেও সম্যক ধারণার জন্য আরও উল্লেখ্য যে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনয়ন, প্রশিক্ষণ ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন; বিশেষত নারী উন্নয়নে সমবায় ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। আশ্চার্যের বিষয় হলো যে, পৃথিবীতে অনেক উন্নত রাষ্ট্রই সমবায়ের কৌশলকে অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়েছে।
আধুনিক কৃষির জন্য, যে পুঁজি, ঝুঁকি এবং যৌথ মেধার দরকার; তার জন্য প্রয়োজন গণমুখী কৃষিভিত্তিক সমবায় ব্যবস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হলে কৃষি সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া খাদ্য নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টিতে অন্যতম এবং উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সমবায়ী উদ্যোগ। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে দেশ ও নিজের জন্য সমবায় প্রতিষ্ঠা।