ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১

মূল্যস্ফীতি

আমদানিনির্ভরতার প্রভাব

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ২ নভেম্বর ২০২৪

আমদানিনির্ভরতার প্রভাব

মূল্যস্ফীতির অর্ধেকের বেশি বা ৫১ শতাংশ এসেছে খাদ্যপণ্য থেকে

স্মৃতি জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের মূল্যস্ফীতির গতিবিধি নিয়ে ইনফ্লেশন ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিয়মিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ তিন মাসে হেডলাইন মূল্যস্ফীতির অর্ধেকের বেশি বা ৫১ শতাংশ এসেছে খাদ্যপণ্য থেকে। এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির বড় প্রভাবক ছিল আমিষ পণ্য, মসলা ও রান্নায় ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় পণ্য। পাশাপাশি চাল, গম ও সবজির দামে ঊর্ধ্বমুখিতারও ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে। এসব পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় জুলাইয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় গত এক যুগে সর্বোচ্চে।

এর আগে নিত্যপণ্যের বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা এত দীর্ঘ সময় বিরাজ করতে দেখা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয়। বিগত সরকারের আমলে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বহিস্থ বা দেশের বাইরের উপাদানগুলোকে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসেছে মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর কারণেই।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, বিগত সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার অভিযানের ওপরেই নির্ভর করছে বেশি। শুধু এর ওপর নির্ভর করে থাকলে তা কার্যকর হবে না। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত আড়াই বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেছে। আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আশা করা হয়েছিল, এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। অথচ মূল্যস্ফীতি এখন এক অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। জুলাই- সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১৫ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে। তবে গত প্রান্তিকের মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব কিছুটা কমেছে। মূল্যস্ফীতিতে গত প্রান্তিকে সেবা খাতের ২৫ শতাংশ ও পচনশীল পণ্যের ২৩ শতাংশ অবদান ছিল।

যেখানে গত জুনে এ দুই খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ১২ ও ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে গত জুনে অপচনশীল পণ্যের অবদান ৭০ শতাংশ থাকলেও গত সেপ্টেম্বরে তা ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের তিন মাসের তুলনায় প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পুরো সময়জুড়েই কাঁচামরিচের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ সময় চাল ও পেঁয়াজের দাম কমার আগে প্রথমে বেড়েছিল। ডিমের দামের মার্জিন স্থিতিশীল হওয়ার আগে কিছুটা কমেছে। আবার এ সময়ে বাজারে সয়াবিন তেল, আলু ও মসুর ডালেও ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে স্থিতিশীল পার্থক্য দেখা গেছে। 
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো বলেন, ‘দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে আমদানি করা পণ্যের অবদানের ক্ষেত্রে। ফলে আগের তুলনায় মূল্যস্ফীতিতে আমদানি পণ্যের প্রভাব কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বন্যা, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্যের মতো বিষয় রয়েছে।

সরকারের মজুদ দিয়ে পণ্য বিক্রি করে বাজারের মূল্যকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা কম। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে পুরোপুরিভাবে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এটি করা গেলে বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে আসত, যা দাম কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার সাধারণভাবে গড়ে কিছুটা কমলেও মূল্যস্তর কিন্তু ওপরেই আছে। ফলে স্থির আয়ের মানুষের জীবনমানের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব অব্যাহত আছে। মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, সে হারে মজুরি বাড়েনি। ফলে বাড়তি দামের কারণে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ‘২০২১-২২ সালের দিকে জ্বালানি তেলের দাম ও ডলারের বিনিময়হার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখলেও এর পরের সময়গুলোয় কিন্তু দেশের নীতিগত ভুলের কারণেই মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়নি। কারণ জ্বালানি ও ডলারের দাম বাড়ার বিষয়টি সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশ কমাতে পারলেও বাংলাদেশ কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি?

তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে বাহ্যিক কারণের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এ বিষয়টির স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক। অতীতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়া হলেও সেটি সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি, বরং সরকার উল্টো পথে হেঁটেছে। সে সময় টাকা ছাপিয়ে কিছু ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ডলারের বিনিময়হারের কারণে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়েছে। শুধু বৈশ্বিক কারণে নয়, সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিও ডলারের বিনিময়হার বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে সরকার বাজেটের আকার কমানোর পাশাপাশি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটলেও বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগের কৌশলই প্রয়োগ করছে। বাজারে যে অব্যবস্থাপনা চলছে সেটি দূর করার জন্য এখনো কার্যকর ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। বাজারে খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হলেও খেলার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুরনো চাঁদাবাজদের জায়গায় নতুনরা এসে চাঁদাবাজি করছে।

আগের মতোই পুলিশ ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। অথচ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। মার্কেট পুলিশিং দিয়ে বিশ্বের কোথাও বাজার স্থিতিশীল করা যায় না, বরং এতে আরও অস্থিরতা বাড়ে। বাজারে নজরদারির ক্ষেত্রে কত দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, কী পরিমাণ পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর মজুদ কেমন আছে, বাজারে নতুন বিক্রেতার অন্তর্ভুক্তির পথ কতটা মসৃণ, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রভাব খর্ব করতে হবে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, বাজারে এর প্রভাব খুবই কম বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর আগে সরকারের গঠিত টাস্কফোর্স দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন প্রভাব রাখতে পারেনি। বাজার পরিদর্শন আর কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যা অতীতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে যথাসময়ে পণ্যের জোগান নিশ্চিত করার মাধ্যমে কারসাজি বন্ধ করা সম্ভব। এ  ব্যাপারে  যা করা প্রয়োজন তা হলো, এক, চাল ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের যে হিসাব দেওয়া হয়, তা বাস্তবের সঙ্গে কম  সংগতিপূর্ণ।

এ জন্য বার্ষিক কী পরিমাণ চাল ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে হবে সে ভাবেই আমদানির ব্যবস্থা করা দরকার, মজুদদারির বিষয়ে কড়া তদারকি বজায় রাখতে হবে এবং বাজারে মূল্য নির্ধারণ ও তা স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে হবে। দুই, সামনের দিনগুলোয় আরও বেশি পণ্যসামগ্রীর উচ্চমূল্য ঘটতে পারে। কারণ মূল্যস্ফীতি এখন একটা বৈশ্বিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বিশ্বে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হয়েছে, দেশে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, কাঁচামালের দাম বাড়ছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ হচ্ছে বা হবে, তেলের দাম বাড়ছে, আমদানিকারকদের আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে।

বিশ্বে ৩০ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি এখন ওপরের দিকে। বৈশ্বিক এ প্রবণতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। সমাজে নিচের দিকের মানুষের আয় বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত তারা  সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে কোনো রকমে চলছে। এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতিতে যে পরিমাণ আয় হচ্ছে, তার সঙ্গে সমাজের এই শ্রেণির মানুষের কোনো সংযুক্তি নেই। এখন মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের দুর্ভোগ কিভাবে কমানো যায় সেদিকে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে।

×