.
চাল আমদানিতে আগে সব মিলিয়ে শুল্ক-কর ছিল প্রায় ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার চাল আমদানি করতে হলে সরকারকে ৬৩ টাকা শুল্ক দিতে হতো। কিন্তু স্বল্প আয়ের ভোক্তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেই শুল্কহার কয়েক দফায় কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে বাজারে সরু নাজিরশাইল-মিনিকেট, মাঝারি মানের পাইজাম-লতা এবং মোটা মানের স্বর্ণা ও চায়না ইরির চালের দাম একটুও কমেনি। যদিও দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ চাল সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়ে থাকে। চালের মতো একই অবস্থা বিরাজ করছে ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমে। এসব ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিভিন্ন হারে শুল্ক সুবিধা দেওয়া হলে বাজারে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, আমদানি শুল্ক কমানোর এই সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ভোক্তাদের বেশি দাম দিয়ে ভোগ্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। শুল্ক কমানোর সুবিধা চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। শুক্রবার সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে চাল, সয়াবিন তেল, আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম বেড়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে চিনির দাম। সংস্থাটির মতে, দাম বাড়ার তালিকায় আরও আছে ডাল এবং রসুন। তবে ব্রয়লার মুরগি, আদা এবং ছোলার দাম কমার তথ্য দিয়েছে টিসিবি। অর্থাৎ যে ছয়টি পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে শুধু চিনি ছাড়া সব বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। শুল্কসুবিধায় আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু অভিযুক্ত অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কখনোই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আসেনি। অন্যদিকে শুল্ক সুবিধা ঘোষণার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে তেমন উৎসাহ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র। এক্ষেত্রে পথে হাটে-মাঠে-ঘাটে নতুন চাঁদাবাজ গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠায় ব্যবসায়ীরা নানামুখী সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া নিত্যপণ্য আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার ব্যাপারে সহযোগিতার নির্দেশনা থাকলেও বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক এখনো পুরোপুরি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি।
ফলে পণ্য আমদানি কম হচ্ছে। তবে মার্চের রমজান মাস সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের আগাম প্রস্তুতি এবং পণ্য আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দির আহমেদ। বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ১০টি খাতের ১০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
সেখানে কয়েকজন ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, রমজান মাস সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের আমদানি, সরবরাহ এবং দাম নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনার বিষয়টি নিয়ে তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেন। শুধু তাই নয়, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য উপদেষ্টা আমদানিতে শুল্কছাড়ের বিষয়টিও ব্যবসায়ীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষকে স্বস্তি দিতে নিত্যপণ্যের দাম কমানো সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি আমদানিতে অনুমোদন দেওয়া হয়। রমজান মাস সামনে রেখে ইতোমধ্যে ছোলা ও খেজুর আমদানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ এসব প্রস্তাব অনুমোদন হতে পারে বলে জানা গেছে।
শুল্কছাড় দেওয়া হলেও দাম কমছে না ॥ দাম কমাতে শুল্কছাড় দেওয়া হলেও বাজারে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট শুল্ক সুবিধায় পণ্য কিনে বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন। ফলে ভোক্তারা ঠকছেন কিন্তু বাজার থেকে বিপুল অঙ্কের মুনাফা তুলে নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারি এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হচ্ছে। এদিকে দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল আমদানির ওপর থেকে আমদানি শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর। বন্যা, আন্দোলন ও ক্ষমতার পালাবদলে সরবরাহ ঘাটতিতে চালের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে এনবিআর এ উদ্যোগ নিয়েছে। চাল আমদানিতে আগে সব মিলিয়ে শুল্ক-কর ছিল ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ (২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ২৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর)।
এর আগে গত ২০ অক্টোবর চালের ওপর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয় ৫ শতাংশ। আর ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু তাতে আমদানিকারকদের তেমন সাড়া না মেলায় আমদানি পর্যায়ে সব শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করে এনবিআরকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। ট্যারিফ কমিশনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর সবকিছু বিশ্লেষণ করে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে শুল্ক ও কর প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এনবিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ বিদ্যমান রেগুলেটরি ডিউটি ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
অর্থাৎ চাল আমদানিতে বিদ্যমান করভার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে (অগ্রিম কর) আনা হয়েছে। এর ফলে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৯ দশমিক ৬০ টাকা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে টিসিবির তথ্যমতে, দাম বেড়ে প্রতি কেজি সরু চাল ৭০-৮০, মাঝারি মানের চাল ৫৮-৬৬ এবং মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। কাওরান বাজারে চালের পাইকারি দোকান বাদশা রাইস এজেন্সিতে চালের যে মূল্য তালিকা ঝুলছিল তাতে পাইকারি দরেও ৬০ টাকার নিচে কোনো চাল মেলেনি। দাম বাড়তে বাড়তে এখন সব চালের দাম পাইকারিতে ৬০ টাকার উপরে চলে এসেছে। আর খুচরাতে ৬৩ টাকার উপরে দর। এই বাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬১ টাকা দরে, স্বর্ণা ৬৩ টাকা কেজি, মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭১-৭২ টাকা দরে। আর খুচরায় এসব চাল কেজিতে ৩-৪ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।
বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি বাড়াতে খাদ্য মন্ত্রণালয় শুল্ক কমানোর জন্য এনবিআরকে চিঠি দেয় সেপ্টেম্বরের শেষে। ওই চিঠিতে বলা হয়, খাদ্য মজুত গড়ে তোলা ও কৃষকদের উৎসাহ দিতে চলতি বোরো মৌসুমে ৫ লাখ টন ধান ও ১৪ লাখ ৭০ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৯৭০ টন ধান ও ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৭ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪০ টন চাল এবং ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৯২৮ টন গমসহ মোট ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ১৯৯ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে।
এদিকে ভোজ্যতেল সয়াবিন খোলা প্রতি লিটার দাম বেড়ে ১৫৮-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ১৭ অক্টোবর এনবিআর পৃথক দুটি আদেশে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন কিংবা পাম তেলের উৎপাদন এবং ব্যবসায়িক পর্যায়ে প্রযোজ্য মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ মওকুফ করা হয়। অপর আদেশে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন কিংবা পাম তেল আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। আমদানি পর্যায়ে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হ্রাস এবং প্রত্যাহার করা হলেও এর প্রভাব বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। এ ছাড়া আলু আমদানিতে যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আছে, তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। অন্যদিকে পেঁয়াজের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে এনবিআর। ডিমের বাজার সহনীয় রাখতে ১৭ অক্টোবর ডিম আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা কার্যকর থাকবে বলে এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
টিসিবির তথ্যমতে, এখন দাম বেড়ে আলু প্রতি কেজি ৫৫-৬৫, পেঁয়াজ দেশী ১৩০-১৫০ এবং আমাদানিকৃত পেঁয়াজ ৮৫-১২০, ডিম ফার্ম প্রতি হালি ৪৮-৫২ এবং খোলা চিনি ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। যদিও ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, উল্লিখিত এসব পণ্য আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম কমে ১৮০-২০০, আদা মানভেদে ১৫০-২০০, টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়ায় বাজারে সব ধরনের সবজির দাম কমে এসেছে। কাওরান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা জানিয়েছেন, সরবরাহ বাড়া অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সবজির দাম কমে অর্ধেকে নেমে আসবে। এ প্রসঙ্গে কাওরান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন সবজিবাহী ট্রাক আসা বাড়ছে। আশা করছি শীঘ্রই সবজির দাম আরও কমে আসবে।
এদিকে সরবরাহ বাড়ায় সবজির দাম কমে আসছে। বাজারে ফুলকপি ৫০ টাকা থেকে কমে ৩০ টাকা এবং লাউ ৮০-১০০ টাকা থেকে ৫০-৬০ টাকায় নেমেছে। কাঁচামরিচের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৬০ টাকা দরে, দুই সপ্তাহ আগেও যা ছিল ২৫০ টাকার ওপরে। বাজারে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে ৬০-৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সবচেয়ে বেশি দামি সবজির তালিকায় রয়েছে শিম, গাজর আর টমেটো। গাজর প্রতি কেজি ১৮০ টাকা, শিম ১৪০ টাকায় ও টমেটো ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য নিয়ে জানান, বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে সরকার বিকল্প কৃষিবাজার চালুর চিন্তা করছে। প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি এই বাজার থাকবে এবং কৃষকরা সেখানে সরাসরি পণ্য বিক্রি করবেন। এতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে।