.
বিনিয়োগ করলেই লোকসান এমনটাই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের নিয়তি। শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল। বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ বাড়ার কারণে যখন তারা রাস্তায় নেমে আসছিল ঠিক সেই সময়েই নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তাতে ফলও দিয়েছে রাতারাতি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের সংস্কারের মতো পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারের নীতি সহায়তা চাওয়া হবে। আর অস্বাভাবিক দরপতন রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ফলে চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়ে যাওয়ার পরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শেয়ারবাজার।
গত দুইদিনে প্রধান শেয়ারবাজারের সূচক বেড়েছে ২৬৬ পয়েন্ট। আর তাতেই বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি ফুটেছে। যদিও আগের ধারাবাহিকতায় বুধবারও রাস্তায় বিনিয়োগকারীরা কর্মসূচি পালন করেছে।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, শেয়ারবাজারে বর্তমান সবচেয়ে বেশি জরুরি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। একমাত্র তাদের আস্থাই শেয়ারবাজারকে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। আর সেই কাজ অবশ্যই শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে করতে হবে। একটু নির্ভরতাই বিনিয়োগকে সুরক্ষা দিতে পারবে।
শাকিল রিজভীর মতো ডিএসইর অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটাই চাওয়া বিনিয়োগকারীরা যেন আস্থা না হারান। সেটি দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। যার ফলে পতন থেমে উল্টোদিকে ছুটছে শেয়ারবাজার।
গত কয়েকদিনের পতনরোধে বাজারে আস্থা ফেরাতে নতুন কমিশন বেশকিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। বাজার সংিশ্লষ্টদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউস, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপসহ নানা পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে বুধবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে আলোচনার জন্য বিএসইসিতে যান।
একগুচ্ছ প্রণোদনা হাতে নেওয়ার আশ্বাস ॥ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ আশ্বস্ত করেছেন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা দিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এসব সহায়তার আওতাভুক্ত হবেন ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, উচ্চ সম্পদশালী বিনিয়োগকারী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা।
বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছেন, অর্থ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নীতি সহায়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। যার মধ্যে কিছু থাকবে স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য, আর কিছু বিষয় মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।
যেসব নীতি পদক্ষেপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তহবিল জোগানে সহায়তা, জরিমানার মাধ্যমে বিএসইসির আদায় করা অর্থ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি ভালো ও লাভজনক কোম্পানিগুলোকে দ্রুত বাজারে আনতে আইপিও আইন সংস্কার ও কর প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, শেয়ারবাজারে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে একদিনে নামিয়ে আনা, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে পরিমাণ অনাদায়ী পুঞ্জীভূত ঋণাত্মক ঋণ (নেগেটিভ ইক্যুইটি) রয়েছে চূড়ান্তভাবে সেগুলোর নিষ্পত্তি করা, উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে মূলধনী মুনাফার কর হার কমানো, শেয়ার পুনর্ক্রয় ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ভবিষ্যতে আর কখনো ফ্লোর প্রাইস আরোপ না করা, সুশাসন ও আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করা।
দরপতনের ঘটনার তদন্ত শুরু ॥ সরকার পতনের কোনো ইতিবাচক ছোঁয়া শেয়ারবাজারে লাগেনি। উল্টো আরও বেশি রুগ্ন হয়েছে শেয়ারবাজার। পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা যখন রাস্তায় নামে ঠিক তখনই চলমান দরপতনকে স্বাভাবিক নয় আখ্যা দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। গত ২৭ অক্টোবর বিএসইসি সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তদন্তের সময় কম হওয়ায় কমিটি গঠনের পরদিন থেকে কাজ শুরু করেছে কমিটি। আগামী সপ্তাহেই কমিটি কমিশনের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।
ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন, টানা দরপতনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। অথচ পুঁজির নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিএসইসি। তারা বলেন, বিনিয়োগকারীরা রাজপথে থাকতে চান না। কিন্তু সরকার ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘পতন ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায়’ বাধ্য হয়ে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, যেসব কোম্পানির শেয়ারের দরপতন সাম্প্রতিক সময়ে সূচকে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেসব শেয়ারের বিক্রিতে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়েছে কি না, এ সময় ঋণ সমন্বয়ে কী পরিমাণ ফোর্সড সেল বা জোর করে বিক্রি হয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহ করবে। এ ছাড়া বাজারের পতন ঠেকাতে করণীয় বিষয়ক সুপারিশের জন্য কমিটি বাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করারও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ারবাজার বিশেষ কারসাজির চক্রের লুটপাটের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রভাবশালীদের সুবিধা দিতে নতুন আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে আইপিও, বন্ড ও রাইট শেয়রের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। আর সেই ধারা থেকে বের হয়ে সংস্কার উদ্যোগ নেয় বর্তমান কমিশন। শেয়ারবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিকমানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার এ এফ এম নেসারউদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।
পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজারের আকার, তথা জিডিপি ও বাজার মূলধন অনুপাত কম হওয়ার প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করা ও উন্নতির জন্য নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের বদলে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়নে সরকারের নীতি প্রণয়ন ও এ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএসইসির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের সুপারিশ করা, বাজার সুশাসনের উন্নতির জন্য বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করে সমাধানের সুপারিশ প্রণয়ন, বিএসইসির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ, ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএল, সিসিবিএলের তদারকি কার্যক্রম বিশ্বমানে উন্নীত করাসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিতে সুপারিশ প্রণয়ন, প্রাইভেট প্লেসমেন্ট-সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ নীতিমালা যুগোপযোগী করতে সুপারিশ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, করপোরেট ঘোষণাসহ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও বাজারের গভীরতা বৃদ্ধির সুপারিশ প্রণয়ন, বাজার মধ্যস্থতাকারীদের জন্য বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান যুগোপযোগী করতে সুপারিশ করা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও আস্থা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান, বাজারে কারসাজি, অনিয়মের বিচার ও জরিমানার সমতা আনতে সুনির্দিষ্ট পেনাল কোড এবং শাস্তির বিধিমালা প্রণয়ন করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি মানসম্মত পদ্ধতি বা নির্দেশিকা প্রণয়ন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানি একীভূত, অধিগ্রহণ সংক্রান্ত হাইকোর্টের অনুমোদনের আগে বিএসইসির অনাপত্তি গ্রহণ সংক্রান্ত সুপারিশ করা ইত্যাদি।
বিএসইসি টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। আদেশে বলা হয়েছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে টাস্কফোর্স তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে হস্তান্তর করবে। এ ছাড়া টাস্কফোর্সের অধীন বিষয়ভিত্তিক ফোকাস গ্রুপ গঠন করা যাবে বলেও আদেশে বলা হয়। কমিশনকে জানিয়ে উপযুক্ত যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এই ফোকাস গ্রুপ গঠন করা যাবে। ফোকাস গ্রুপ তাদের জন্য নির্ধারিত বিষয়ে কাজ করবে ও টাস্কফোর্সের কাছে তাদের সুপারিশ তুলে ধরবে। সম্প্রতি গঠিত টাস্কফোর্স এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সংস্কার সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য ই-মেইলেও পাঠানো যাবে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক দরপতনের পেছনে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাই মূল কারণ। এছাড়া ব্যাংকের আমানতের সুদহার বৃদ্ধি এবং শেয়ারবাজারে চলমান কিছু বড় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অধিকন্তু বেশকিছু শেয়ার হঠাৎ করেই জেড ক্যাটাগরিতে চলে যাওয়ার কারণে ফোর্সড সেলের ঘটনাও ঘটেছে। সবমিলে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়েছিল। ফোর্সড সেলের চাপ কমে যাওয়া এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃশ্যমান ইতিবাচক পদক্ষেপে বাজারে সূচক বাড়তে শুরু করেছে।