ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

ডিমের বাজারে ফের শঙ্কা

প্রকাশিত: ০০:২১, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

ডিমের বাজারে ফের শঙ্কা

ডিম

কয়েক দিন স্বস্তিতে পার হওয়ার পর সরবরাহ সংকটের অজুহাতে ফের উত্তাপ বাড়ছে ডিমের বাজারে। পোলট্রি শিল্পের বড় কোম্পানিগুলো রাজধানীর বাজারে দৈনিক ২০ লাখ পিস ডিম সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও, সেই কোটা পূরণ করছে না। উল্টো এসব প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম-সংকট সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়ত মালিকদের। যার ফলাফল হিসেবে চলতি সপ্তাহ থেকেই আবারও ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় ডিমের বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। সরকারের অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ঢাকায় দুদিন ডিমের সরবরাহ বন্ধও রাখে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। পরে ১৫ অক্টোবর রাত থেকে আবার তেজগাঁওয়ের আড়তে ডিমের ট্রাক ঢোকে। এর আগে ওইদিন এক বৈঠকে ডিমের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার প্রতিশ্রুতি দেন ব্যবসায়ীরা। ওই বৈঠকে রাজধানীর তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারে প্রতিদিন ২০ লাখ পিস ডিম সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয় শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ডিম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। ভোক্তা অধিদপ্তরে পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কো-অর্ডিনেশন কমিটি বা বিপিআইসিসির সভায় এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

কাজী ফার্ম, ডায়মন্ড, প্যারাগন ও নারিশসহ শীর্ষস্থানীয় ১৩টি ডিম উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের রাজধানীর তেজগাঁও এবং কাপ্তানবাজারে প্রতিদিন এই ২০ লাখ পিস ডিম দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু কিছু কোম্পানি ডিম সরবরাহ করলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ডিম সরবরাহ করছে না। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান ডিম সরবরাহ করছে, তারাও অর্ধেক ডিম দিয়ে দায় সারছে। গতকাল শনিবার কারওয়ান বাজার ও ডিমের বড় পাইকারি আড়ত তেজগাঁও বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

তেজগাঁও বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক সপ্তাহে ৮টি কোম্পানি থেকে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭২ পিস ডিম সরবরাহ হয়েছে। গড়ে দৈনিক ডিম এসেছে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮১ পিস, যা দৈনিক চাহিদার মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে কাজী ফার্মস প্রায় ১০ লাখ, ডায়মন্ড ৫ লাখ ৬০ হাজার, প্যারাগন ১ লাখ ১৯ হাজার, পিপলস পোলট্রি ৬৩ হাজার ৮০০, নারিশ ৮২ হাজার ৩২০ এবং আরআরপি ব্রিডার্স ফার্মাস ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ পিস ডিম সরবরাহ করেছে।

এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের ‘যৌক্তিক দর’ নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী, উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, যা পাইকারিতে হবে ১১ টাকা শূন্য ১ পয়সা। আর খুচরাপর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম রাখতে হবে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা করে। প্রতি ডজন ডিমের দাম হবে ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। কিন্তু দর নির্ধারণের পর সেই দরে কোথাও পাওয়া যায়নি ডিম। উল্টো ধীরে ধীরে দাম বাড়ছে।

বাজারের এমন পরিস্থিতিতে সরকার সম্প্রতি ডিমের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। কয়েক ধাপে আমদানিও হয়। তবু বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

ডিম ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আমানত উল্লাহ বলেন, ‘সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ডিম বিক্রি করতে গিয়ে আমাদের আড়তে ডিম নেই। অধিকাংশ দোকান ফাঁকা রয়েছে। কোম্পানিগুলো তাদের কথা অনুযায়ী আমাদের ডিম সরবরাহ দিচ্ছে না। যারা ডিম দিচ্ছে, তাদের সংখ্যাও কম। ফলে ডিমের বাজারে আবারও সংকট দেখা দেবে।’

তেজগাঁও ডিমের আড়ত ঘুরে দেখা যায়, প্রতি ১০০ ডিম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০১ টাকায়। পিস হিসেবে ১১ টাকা ১ পয়সা আর ডজন হিসেবে ১৩২ টাকা ১২ পয়সা।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাজারে ডিমের দাম না বাড়লেও চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণে ডিম সরবরাহ করার কথা, তা ঠিকঠাক দিচ্ছে না। কোনো কোনো দিন অর্ধেকের কমও ডিম বাজারে আসছে।

গতকাল বিকেলের দিকে কারওয়ান বাজারে খুচরা ডিমের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। পিস হিসেবে প্রতিটি ডিমের খুচরা দাম ১২ টাকা ৫ পয়সা। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোয় প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী মো. শরিফ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী আড়তে ডিম পাওয়া যায় না। দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকায় মানুষ প্রচুর ডিম কিনছে। প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা করেই। আর ভাঙা ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।’

বাজারে ডিমের সরবরাহ কমার বিষয় তেজগাঁওয়ের এক ব্যবসায়ী বলেন, কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত ডিম সরবরাহ করছে না। তবে তারা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ডিম সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরসহ দেশের অন্যান্য জেলায় বেশি দামে বিক্রি করছে।

তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিদিন ১০ লাখ ডিম দেওয়ার কথা রয়েছে করপোরেট কোম্পানিগুলোর। তবে তারা আমাদের অর্ধেক ডিম দিচ্ছে।’ এর বড় একটা কারণ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত মূল্যে ১১০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। আমাদের বাজারে বেশি দাম না পাওয়ায় দেশের প্রান্তিক খামারিদের থেকে ডিম সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও চাঁদপুরসহ অন্যান্য জেলা শহরে প্রতি ১০০ ডিমে ৬০ থেকে ৭০ টাকা বেশি দামে তারা বিক্রি করছেন। তা ছাড়া ফড়িয়া সিন্ডিকেটের লোকরাও ডিমের বাজার অস্থিতিশীল গড়ে তোলার সঙ্গে জড়িত।’

কাপ্তানবাজার ডিম ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়ক মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কাপ্তানবাজারে ৫ জন ডিলারকে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডিম সরবরাহ করেন। বাকি ব্যবসায়ীরা ডিম সংগ্রহ করেন মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। এখন সরকার নির্ধারিত দরে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডিলারদের ডিম দিচ্ছেন। ডিলাররাও নির্ধারিত দরে ডিম বিক্রি করেন। অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করলে দর বেশি দিতে হচ্ছে। ফলে বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দরে। কিন্তু সেই সুযোগ নেই বাজারে। ফলে তারা ডিম সংগ্রহ থেকে বিরত রয়েছে। এ কারণে সংকট তৈরি হয়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলীম আক্তার খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাজার তদারকি ও ভোক্তার জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে অধিদপ্তর কাজ করছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হবে।

শিহাব উদ্দিন

×