ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১

ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ মনে করছেন অনেকে

পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না, বিনিয়োগকারীরা হতাশ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:১৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না, বিনিয়োগকারীরা হতাশ

.

মুনাফার আশায় এসে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এমনটিই যেন বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে নিয়তি। মাঝেমধ্যে কিছুটা সূচকের ওঠানামা থাকলেও হতাশা যেন এখানকার নিত্যদিনের চিত্র। প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তি শ্রেণি এবং বিদেশী সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা হতাশ এখানে বিনিয়োগ করে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজির মাধ্যমে একটি পক্ষ মুনাফা করে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের একটি শ্রেণিও সুবিধা পায়। যদিও ওই সময়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অন্য একটি অংশ লোকসানে পড়ে যায়। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী পক্ষরা সুবিধা নিয়ে শেয়ারবাজার থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু এখন তারা নেই। তাই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে গেলেও কেন টানাপতন?

পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসেছে, এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। লোকসানের পরিমাণ এত বেড়েছে যে কিছু লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যাবেন, সে চিন্তাও ছেড়ে দিয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আশাবাদী হয়ে যারা শেয়ার কিনেছিলেন, তারাও লোকসানে। কোনোভাবেই দর পতন থামছে না।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অক্টোবরের ১৬ কার্যদিবসের মধ্যে ১২ দিনই দর হারিয়েছে সিংহভাগ শেয়ার। সময়ে চার দিন ডিএসইএক্স সূচক ১৮৮ পয়েন্ট বৃদ্ধির বিপরীতে বাকি ১২ দিনে ৬৯৮ পয়েন্ট হারিয়েছে। শুধু গত দুই দিনে সূচক ১২৭ পয়েন্ট হারিয়ে নেমেছে ৫১১৪ পয়েন্টে। সূচকের অবস্থান গত ১৩ জুনের পর বা প্রায় সাড়ে চার মাসের সর্বনি¤œ

খন্দকার রাশেদ মাকসুদ গত ১৯ আগস্ট যখন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন, তখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল হাজার ৭৭৫ পয়েন্ট। বৃহস্পতিবার প্রধান সূচক বা ডিএসইএক্স দাঁড়িয়েছে হাজার ১১৪ পয়েন্টে। অর্থাৎ নতুন কমিশনের আমলে মোট সূচক কমেছে ৬৬১ পয়েন্ট। সেই হিসেবে নতুন কমিশন বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আস্থা হারিয়েছেন সিংহভাগ বিনিয়োগকারী। ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতা অনেক বেশি। অবস্থা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হলো, গত আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও দেশে বিভিন্ন কারণে অস্থিতিশীলতা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রপ্তানি আয়ে কিছু প্রবৃদ্ধি ডলার সংকট কমিয়েছে। এতে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তার প্রভাবে ব্যাংকে সুদহার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এতে ভবিষ্যতে শিল্পে বিনিয়োগ কমার শঙ্কা আছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারের বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারে লগ্নি করার তুলনায় ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সুদ আয়কে বেশি নিরাপদ মনে করছেন। এতে শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহ কমেছে।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ থেকে প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের পদত্যাগের পর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকুসদকে নিয়োগ দেয় সরকার। চেয়ারম্যানের পাশাপাশি কমিশনারদেরও সরানো হয়। রাশেদ মাকসুদ নিয়োগ পেয়েই সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিও হিসাব জব্দসহ ব্যাংক হিসাব তলব করেন। এতে বিপুলপরিমাণ টাকা এবং শেয়ার লেনদেনের অযোগ্য হয়ে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে। বর্তমান কমিশনের আমলে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়, একদিনে ২৭টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি। জেড ক্যাটাগরিতে এতগুলো কোম্পানি রাতারাতি স্থানান্তরের কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগ ননমার্জিন হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের কারণে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেছে। আইন অনুসারে জেড ক্যাটাগরির শেয়ারে মার্জিন ঋণ প্রদানের বিধান নেই। সাম্প্রতিক দরপতনের পেছনে বাজার বিশ্লেষকরা এটিকেই সবচেয়ে বড় কারণ মনে করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্চেন্ট ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন কমিশনের আমলে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর নির্দেশনাটি শেয়ারবাজারকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। শেয়ার বিক্রি করা ছাড়া বিনিয়োগকারীদের সামনে আর কোন পথ থাকছে না। উল্টোদিকে শেয়ারের ক্রেতা নেই। বিক্রেতার চাপ বেশি থাকার কারণেই শেয়ারবাজারটি এমন হতাশায় পড়েছে। আর নতুন নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। আশ্বস্ত না হওয়ায় নতুন বিনিয়োগে  তার বাজারে আসছে না। উল্টোদিকে ব্যাংকের সুদহার এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ হার আগের তুলনায় বেড়েছে। ফলে মানুষ নিশ্চিত মুনাফা জেনে লোকসানে হলেও হাতের শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রাখছে এবং সঞ্চয়পত্র কিনছে। মূলত শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগের তুলনায় বের হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বর্তমান বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা আর কোনো উপায় না পেয়ে টানা শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেছে। যখন দেখছে শেয়ারবাজারে কোনো অভিভাবক নেই তখন নিরুপায় হয়ে শেয়ারবাজার থেকে বের হতে যেতে চাচ্ছে। বিএসইসিসহ বাজার সংশ্লিষ্টদের উচিত বাজারে আস্থা ফেরাতে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া।

শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই, একসময় বেশ কিছু কারসাজি চক্র শেয়ারবাজারের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। সংঘবদ্ধভাবে অনুসারীদের নিয়ে কোনো কোনো শেয়ারের দর বাড়িয়েছে, বাজারে চাহিদা তৈরি করেছে। তাদের দেখাদেখি অন্য শেয়ারের দরও কম-বেশি বেড়েছে। এখন তারা শেয়ার কেনাবেচায় সক্রিয় নেই। ফলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমেছে। এর মধ্যে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় কৌশলী বড় বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে নিরাপদ বিনিয়োগে চলে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়েছে, যা থেকে বের হতে পারছে না।

×