ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

সুশাসনের অভাবে ব্যবসা কমেছে উত্তরা ফাইন্যান্সের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

সুশাসনের অভাবে ব্যবসা কমেছে উত্তরা ফাইন্যান্সের

উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড

দুই বছর আগেও দেশের ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ছিল উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। সুশাসনের অভাবে সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এখন সংকটাপন্ন ও রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের অব্যবস্থাপনার কারণে উত্তরা ফাইন্যান্সের ব্যবসা ও মুনাফা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তারল্য সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা কোম্পানির নামে বিলাসবহুল বহুল গাড়ি কিনে পারিবারিকভাবে ব্যবহার করছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই খরচ চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য, এটি সুশাসনের চরম লঙ্ঘন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এভাবে অর্থ ব্যয় কেন হচ্ছে খতিয়ে দেখা। আর্থিক রেকর্ডে অসঙ্গতি, বোর্ড পুনর্গঠন ও গত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দিলেও উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস এ বছর প্রচুর টাকা খরচ করেছে অপ্রয়োজনীয় খাতে। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উত্তরার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করে পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন বোর্ড গঠন করে। তবে দৃশ্যত এর তেমন প্রভাব পড়েনি কোম্পানির পরিস্থিতি উন্নয়নে।

কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, তিন বছরেও বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করতে পারেনি। এক সময়ের এক ক্যাটাগারির উত্তরা ফাইন্যান্স এখন জেড ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গত দেড় বছরে উত্তরা ফাইন্যান্সের বিতরণকৃত একটি টাকাও ফেরত আসেনি। খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা না করে মামলা করায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। 
বেসরকারি খাতের উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এই দৈন্যদশা শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে স্বতন্ত্র পর্ষদ গঠন করা হয়। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণের পর চাকরিচ্যুত করা হয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অর্ধশত কর্মকর্তাকে। নিয়োগ দেওয়া হয় তৎকালীন গভর্নরের ঘনিষ্ঠদের। মূলত তারাই উত্তরা ফাইন্যান্সকে রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এ অবস্থায় চলতে থাকলে হয়তো এক সময় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া অভিযোগের তথ্যমতে ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রতিটি শেয়ারের দর ছিল ৫৫ টাকা। ঢাকা স্টক একচেঞ্জ সূত্র জানায় ৯ অক্টোবর কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা। বর্তমান পরিচালকরা দায়িত্ব গ্রহণের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় কোম্পানির আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সর্বশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় ১৮ দশমিক ৭৮ টাকা লভ্যাংশ দিলেও চার বছর ধরে শেয়ারহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হচ্ছে না।

বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বছরে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বিপরীতে আদায় খরচের চেয়ে কম। ফলে প্রতিষ্ঠানের মূলধন ঘাটতি হচ্ছে এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়ছে। ৪ বছর যাবত ভবনের ভাড়াও পরিশোধ করছে না বর্তমান পর্ষদ। 
জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে উত্তরা ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ এক কোটি ৫৪ লাখ টাকায় দুটি হোন্ডা সিআর-ভি ১.৫ টার্বো বা স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) কেনার অনুমোদন দেয়। প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষ ব্যবস্থাপনা ও বোর্ড থেকে ২৫ কর্মকর্তাকে কক্সবাজারে নিয়ে আসে। গত ৭ থেকে ৯ মার্চ কৌশলগত ব্যবসায়িক বৈঠকের জন্য তাদেরকে ব্যয়বহুল হোটেলে রাখতে ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা খরচ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির সৌজন্যে কয়েকজন বোর্ড সদস্যের সঙ্গে তাদের সহধর্মিণীরাও ছিলেন।

তাদেরকেও উপহার দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, এই খরচ অগ্রহণযোগ্য। এটি করপোরেট সুশাসনের চরম লঙ্ঘন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা। উত্তরার প্রকৃত আর্থিক অবস্থা চিহ্নিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, উত্তরা ফাইন্যান্সের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

×