ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

বাংলাদেশের জিডিপি কমে ৪ শতাংশে নামতে পারে ॥ পূর্বাভাস বিশ^ব্যাংকের

অর্থনীতি চাপে থাকবে আরও এক বছর

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:১২, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

অর্থনীতি চাপে থাকবে আরও এক বছর

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও এক বছর চাপে থাকবে

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও এক বছর চাপে থাকবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে চার শতাংশে নেমে আসতে পারে। তবে সংস্থাটি কিছুটা আশার বাণীও শুনিয়েছে। তারা বলছে, চলতি বছরে জিডিপি কমলেও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সেটি বেড়ে দাঁড়াতে পারে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। সংস্থাটি বলছে, ২০২৪-২৫ সালে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে পারে। তবে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে নিত্যপণ্যের দাম কমানো কঠিন বলেও তারা মনে করছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, করোনা মহামারি সংকটের পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। ফলে প্রবৃদ্ধি কমে ২০২৪ সালে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হবে পাঁচ দশমিক ২ শতাংশ।
মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির ধারা কমছে দেশে, যদিও সংস্থাটি ২০২৩ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা জানিয়েছিল। এ ছাড়া ২০২৫ সালে দেশে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হবে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ যে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সেগুলো হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বৈশ্বিক খাতের চাপ।
প্রতিবেদনে আর্থিক খাত নিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নানা ধরনের সংকট মোকাবিলা করছে। বিশেষ করে এখানে খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। সরকারের অনেক প্রচেষ্টার পরও সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ কমেছে।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, মধ্যবর্তী পয়েন্ট হবে ৪ শতাংশ। যদিও এর আগে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বিশ্বব্যাংক এপ্রিলে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল।
চলমান অর্থবছরের বাজেটে সদ্য পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেই হিসাবে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস সরকারি লক্ষ্যের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ কম হবে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী কমে গেলে তা হবে করোনা মহামারির পর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের পূর্বাভাস কমানোর পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংক গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির  প্রাক্কলনও কমিয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। গত অর্থবছরের জন্য সরকারের সাময়িক প্রাক্কলন ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। 
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শ্রম বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ফাঁক রয়েছে। সেটি  শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার ‘মিস ম্যাচ’ আছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি খারাপ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এতে।
সংবাদ সম্মেলনে ওয়াশিংটন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক। এই সময় উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ নাজমুস খান এবং বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি। অথচ প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ শ্রম বাজারে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে শিক্ষিত ও শহুরে বেকার বৃদ্ধি পাওয়াটা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। 
তিনি আরও বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। নানা উদ্যোগ নিয়েও এটি কমানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানকে নিচে নামাচ্ছে। পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে বাংলাদেশে। এক্ষেত্রে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কার দ্রুত করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
মুদ্রানীতি দিয়ে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম কমানো কঠিন ॥ বিশ্বব্যাংকের মতে, অর্থনৈতিক নানা সংকটে বাংলাদেশের উন্নয়ন হারিয়ে যাচ্ছে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানালেও বিশ্বব্যাংক মনে করে, মুদ্রানীতি দিয়ে বর্তমানে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব নয়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পণ্যের দাম বাড়ছে সরবরাহ সংকটে। জুলাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি। সেই কারণে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। 
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নি¤œমজুরি, দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক খাত এবং শিল্পখাতের নানা বাধায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পড়েছে। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে ৪ শতাংশে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। যদিও সংস্থাটি  মনে করে এ মুহূর্তে পণ্যমূল্যের লাগাম টানাই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কেবল মুদ্রানীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান কঠিন। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হচ্ছে সরবরাহ ঘাটতির কারণে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ধ্রুব শর্মা জানান, খাদ্যের দাম ৪৫ শতাংশ বেড়েছে সরবরাহ সংকটের কারণে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ছাড়াও বৈরী আবহাওয়ায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ হারে হচ্ছে। তবে আমাদের পূর্বাভাস বছর শেষে তা ৭ শতাংশে নেমে আসবে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারিখাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ দিচ্ছে সংস্থাটি।

বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা ও জ্বালানি সংকট দ্রুত দূর করার পরামর্শ দেন তিনি। ধ্রুব শর্মা জানান, শ্রম পরিবেশ বা কর কাঠামো নয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগে এখনো বড় বাধা সরকারি সংস্থার অনুমোদন পাওয়া। দেশের অর্থনীতিকে আবারও চাঙ্গা করতে নির্মোহ সংস্কারের পাশাপাশি মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পরামর্শও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

×