দেশের যে কোনো ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি
দেশের যে কোনো ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, দখল এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে অপকর্মের সুযোগ নেওয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাণিজিক্য প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদ রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার রয়েছে দলটি।
বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী শুক্রবার নয়াপল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সুযোগ-সন্ধানীদের বিষয়ে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ কেউ প্রবাসে অবস্থান করে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো জীবনযাপন করে এখন দেশে ফিরে এসে প্রভাব খাটিয়ে আরও বেশি স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় তৎপর রয়েছে। তারা প্রশাসন, ব্যবসায়ী মহল ও মিডিয়া হাউসসহ নানা প্রতিষ্ঠানে খবরদারি করার চেষ্টা করছে।
আমি এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরদারি সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে সচেতন থাকার অনুরোধ করছি। এ সকল ব্যক্তিদের কেউ বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করে না। উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তার নেতৃত্বে দেশে যখন বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের কাজ এগিয়ে চলছে ঠিক সেই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও দলীয় কর্মী পরিচয় দিয়ে অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যিক, আর্থিক ও সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এতে করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অথচ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি, দখল, লুটপাট এবং যে কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, দলীয় পরিচয়ে যারা চাঁদাবাজি কিংবা অন্য কোনো অপকর্মে জড়িত হবে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথাও বলেছে বিএনপির হাইকমান্ড।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পরই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, চাঁদাবাজরা যে দলেরই হোক তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিরতার পিছনেও চাঁদাবাজদের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন চাঁদাবাজ, দখলকারী এবং অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দিকে বিশেষ নজর রাখার জন্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তথ্যমতে, বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
সর্বশেষ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নৈতিকতা পরিপন্থি কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবিকে শোকজ করেছে দলটি। শুক্রবার সন্ধ্যায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক চিঠিতে এ শোকজ করা হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নয়াপল্টনে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে। এর আগে রাজধানীর রামপুরার মহানগর প্রজেক্টে ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দীপ্ত টিভির কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিমকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় এরই মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার ১৬ জনকে আসামি করে যে মামলা করেছে, তাতে তিন নম্বর আসামি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শেখ রবিউল আলম রবি। প্লিজেন্ট প্রোপার্টিজ নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অনেকেই দলীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চেয়ারম্যানদের কাছে গিয়ে চাঁদা দাবি করছে। এমনকি ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দখলেরও হুমকি-ধামকি দিচ্ছে তারা। এমন অনেকে আছেন যারা ৫ আগস্টের আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন তারা এখন নব্য বিএনপি সেজে চাঁদা দাবি করছে। এছাড়া কয়েকজন সংখ্যালঘু উদ্যোক্তা অভিযোগ করে বলেন, তারা সবচেয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে, না দিলে প্রতিষ্ঠান দখলের হুমকি দিচ্ছে। অথচ বিএনপির হাইকমান্ড শুরু থেকে এসব কর্মকা-ের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর যে অবস্থান তা প্রশংসনীয়। কিন্তু বিএনপির দলীয় নেতাকর্মী পরিচয় দিয়ে যারা এসব অপকর্ম করছে কিংবা সুযোগ খুঁজছে তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। জানা গেছে, বিভিন্ন মার্কেটের দোকান, ফ্যাশন হাউস, স্বাস্থ্যখাত বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লিজ গ্রহীতা, পণ্যবাহী পরিবহন, কাঁচাবাজার, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, রপ্তানি ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দিকে হাত বাড়িয়েছে চাঁদাবাজ গ্রুপ।
চাহিদামতো চাঁদা না দিলে প্রতিষ্ঠান দখলসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রর্দশন ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে করে দেশের অর্থনীতিতে নতুন চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে। এদিকে, শুক্রবার নয়াপল্টনে এক সংবাদ সতর্কবার্তা দিয়ে রুহুল কবির রিজভী আরও বলেন, প্রশাসন, ব্যবসায়ী মহল ও মিডিয়া হাউসসহ নানা প্রতিষ্ঠানে অনেকেই খবরদারি করার চেষ্টা করছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ সকল ব্যক্তিদের কেউ বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করে না। তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছর দুর্বিষহ মহাযন্ত্রণার ফ্যাসিবাদী অপশাসন সহ্য করতে গিয়ে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর প্রাণ ঝরে যায়, অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে, চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যায় অনেক।
চিরতরে হারিয়ে যায় গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বরের বিপ্লবী নেতাকর্মীরা। অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে নিজ দেশেই বাস্তুহারা শরণার্থীতে পরিণত হন তারা। গত ৫ আগস্টের বিপ্লবের গুরুত্ববহ ঘটনা যখন ১৬ বছর ধরে নিপীড়িত দেশবাসীকে সোনালি ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করছে তখন দলের নাম করে কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির সুবিধাবাদী ভূমিকা সম্পর্কে সবার ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দেশনায়ক তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও ৬০ লাখ নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলা ও ফরমায়েশি সাজা দিয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তির যবনিকাপাত ঘটানোর আয়োজন করা হয়েছিল।
নিপীড়নের চরম অভিঘাত, অপ্রীতিকর ও মর্মপীড়াদায়ক ঘটনার ধারায় নিপীড়নের চাপে জর্জরিত নেতাকর্মীরা যখন অসহায় এবং ধ্বংসের মুখোমুখি ঠিক সেই সময়ে নিজেদের আত্মসুখ বৃদ্ধির জন্য দেশ ও দল ছেড়ে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়। কেউ সুবিধা আদায়ে দলীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। সেই দুঃসময়ে অনেকেরই কোনো খবর ছিল না। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুকূল পরিবেশে অনেকে নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির মানসে প্রশাসনকে নিজ অনুকূলে প্রভাবিত করাসহ নানা প্রতিষ্ঠানে হানা দিচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।