ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে সেমিনার

আইনশৃঙ্খলার উন্নতি চান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ৫ অক্টোবর ২০২৪

আইনশৃঙ্খলার উন্নতি চান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির ওপর জোর দিয়েছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তারা বলছেন, এরসঙ্গে প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা, ব্যাংক ঋণের সুদহার, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ সামগ্রিকভাবে যে টানাপোড়ন চলছে তাতে অর্থনীতির আকার ছোট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, মূল্যস্ফীতিও কমবে না। এজন্য একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 
শনিবার ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে অংশ  নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তারা বলেন, বর্তমান সরকারকে ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বাড়াতে হবে।

এতে সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আগে উন্নতি করতে হবে। মালিক-শ্রমিক কেউ কারখানায় নিরাপদ নয়। এ অবস্থার উত্তরণ না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে এক ধরনের টানপোড়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। যেখানে বিনিয়োগ হবে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারবেন। সেটি প্রধানত সরকারকেই করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের যে দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব ব্যবসায়ীদেরও পালন করতে হবে। এছাড়া ঢাকা চেম্বার সভাপতি শিল্পাঞ্চল সমূহে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ প্রদানের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। এছাড়াও শিল্পাঞ্চল সমূহে বিশেষ করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা স্বল্পমূল্যে নিশ্চিতকরণে সরকারি বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবি জানিয়েছেন।

সেমিনারে অংশ নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, বর্তমানে কার্যকরী সুদহার ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আগামী মার্চ থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ না করলেই সেই প্রতিষ্ঠান খেলাপি হবে। তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির উদ্যোগ চান। একইসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার ও সুদহার কমানোর দ্রুত পদক্ষেপ আশা করেন। বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ইন্ধন ছাড়া কোনো শ্রমিক অসন্তোষ হয় না। ৪০টি খাতে মজুরি নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

কিন্তু একমাত্র তৈরি পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে। অন্য খাতগুলোতে কি মূল্যস্ফীতির প্রভাব নেই?  তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ হারের কারণে অনেক কিছু সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগামীবছরের মার্চ মাস থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ না করলেই খেলাপি করার যে নিয়ম করা হয়েছে, তাতে ৯০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়বেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এই পলিসি নিলো সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।

এতে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে ধরা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন সবচেয়ে বড় সংকট গ্যাস সংকট। এর কারণে সময়মতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না, রপ্তানি হচ্ছে না। বেশিরভাগ কারখানার বেতন দিতে অসুবিধা হচ্ছে। এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা ভীষণ নিরাপত্তাহীনতাবোধ করছি। কালকে কী হবে, কী টেলিফোন আসবে এ রকম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আশুলিয়া, গাজীপুরে শুধু শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে তা নয়।

সেখানে অন্য বিষয়গুলো ছিল। সরকারকে এখন ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে হবে যে, বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য নিরাপদ। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে ১৪-১৫ শতাংশ সুদহার ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্য। এসব ধরে বিশ্বের কোথাও কেউ ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে না। সবকিছু ফাইনাল করেও দুটো কোম্পানির এফডিআই আসছে না। তারা ওয়েট অ্যান্ড সী নীতিতে আছে। তিনি বলেন, শুধু রেমিটেন্স ও দাতা গোষ্ঠীর টাকা দিয়ে একটা দেশ চলতে পারে না। রপ্তানি আয় ও অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখতে হবে।

এছাড়াও প্রশাসনের অনেক জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, এক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকরের নিকট হতে সুনির্দিষ্ট বার্তা প্রদান করা আবশ্যক। তিনি আরও বলেন, ঠিক জায়গায় ঠিক লোক বসালে ভালো ফল দেয়। এই সরকারের আমলে সে প্রমাণ পাচ্ছি। ইতোমধ্যে ব্যাংক মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। বিনিময় হার অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান গভর্নরের ওপর ব্যবসায়ীদের আস্থা আছে। 
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, এখন যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে হবে। শিল্প পুলিশকে কার্যকর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হলেই সবকিছু ঠিক হবে।  তিনি আরও বলেন, সুদহার বেড়ে ১৬ শতাংশ হয়েছে। এটা কমাতে না পারলে খেলাপি ঋণ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না।

তিনি এলসি খোলা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানান। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে হবে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ব্যাংকের সুদ হার কমানোর জরুরি হয়ে পড়ছে। মাস্টার কার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ট্রাফিক জ্যাম ইত্যাদির কারণে শপিংমলে কেনাবেচা কমে গেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে জুলাইয়ে ৪০ ভাগ এবং আগস্টে ৩৫ ভাগ ডিজিটাল লেনদেন কমে যায়। সেপ্টেম্বরের সেটা কিছুটা বেড়েছে। তবে সাপ্লা চেইন এখনো ঠিকমতো কাজ করছে না যে কারণে মূল্য কমছে না। 
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে আমরা গত দুই বছরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার প্রভাব বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের আস্থার পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে শিল্পখাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মাঠপর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

যেটি মোটেই কাম্য নয়, সরকারকে এ বিষয়টিতে নজর দেওয়া জরুরি। ফুডপান্ডা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং সিইও আমব্রারিন রেজা বলেন, গত ৩ মাসে ইন্টারনেট সেবা বিঘিœত হওয়ায় বিশেষ করে ডিজিটাল সেব খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং এ খাতের অধিকাংশই উদ্যোক্তাই এসএমই, যাদের ব্যবসায়িক কর্মকা-ে স্বাভাবিক করতে দ্রুততম সময়ে স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করা জরুরি।

এছাড়াও সারাদেশে ডিজিটাল সেবাখাতের সম্প্রসারণে ইন্টারনেট প্রাপ্তির খরচ হ্রাস করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। ঢাকা চেম্বারে ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দসহ বেসরকারি খাতের আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

×