ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

সমবায়ভিত্তিক কৃষি প্রজেক্ট

কর্মসংস্থানের সুযোগ

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২২:১৮, ৫ অক্টোবর ২০২৪

কর্মসংস্থানের সুযোগ

সমবায়ভিত্তিক কৃষি প্রজেক্ট

বাংলাদেশের সমবায়ের ইতিহাসে ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমল দুটিরই উপস্থিতি পাওয়া যায় বিভিন্ন অবয়বে। এসব অভিজ্ঞতার ফসলগুলো আমাদের গবেষণায় খোরাক জোগাবে এবং বাড়তি নতুন প্রকল্প তৈরিতে সহায়তা করবে। যেমন দুস্থ কিংবা তিন স্তর সমবায় কাঠামোর আদলে সার্বিক গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচি, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইত্যাদি।

দেশে প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির সমবায় (সমবায় অধিদপ্তর) ও কুমিল্লা পদ্ধতির সমবায় এই দুটি কেবল দাপ্তরিক নথিতেই সচল আছে তা বলা যাবে না। যদিও সরকারি দপ্তর হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের চাকরির সকল সুবিধা পাচ্ছে । কিন্তু ‘সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষির রূপান্তরের যে সূচনা হয়েছিল সামাজিক পুঁজির বিকাশে তা আর তেমনটি নেই। এখন সেই জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যাদের বলা হয় এনজিও অথচ অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ব্যবসায়িক সংগঠন হিসাবে অর্থনীতির উন্নয়নে সমবায়ের বিকল্প নেই। 
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনকে পলিসি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ষাটের দশকে তদানীন্তন সরকার বার্ড নামে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিল যার প্রায়োগিক গবেষণার ফসল কুমিল্লা  মডেল (দুস্থ  বিশিষ্ট সমবায়, পল্লী পূর্ত কর্মসূচি, থানা সেচ কর্মসূচি, থানা প্রশিক্ষণ উন্নয়ন কেন্দ্র)  তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের অনুকূলে থানা পর্যায়ে তাদের পরিকাঠামো বিস্তার করে সারা পৃথিবীতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং এর পরবর্তীতে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের জন্য এটাই ছিল সরকারি পর্যায়ের একমাত্র কার্যক্রম।

সময়ের আবর্তে পল্লী পূর্ত কর্মসূচি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দুস্থ বিশিষ্ট সমবায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড রিআরডিবি, থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র টিটিডিসি এবং থানা সেচ কর্মসূচি টিআইপি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে বিআরডিবি দুস্থ বিশিষ্ট সমবায় বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল এবং এখনো আছে। প্রতিটি থানায় (বর্তমানে উপজেলায়) থানা সেন্টাল কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন যা গ্রাম সমবায় সমিতির (কেএসএস) থানা পর্যায়ে ফেডারেশন সমবায় সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছিল এবং সমিতির চেয়ারম্যান, মডেল ফার্মার ও ব্যবস্থাপকগণ প্রতি মাসেই আসত থানা  উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ।
সমবায়ের সেই আয়োজন কৃষি উন্নয়নে একটি গতিশীল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে উফশী ধান সম্প্রসারণে। কিন্তু আশির দশকে যখন বাজার অর্থনীতি ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে তখন থেকেই কাজ করার সামাজিক আচরণগুলো বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে এককেন্দ্রিকতা সমবায়ীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সমসাময়িক সরকারগুলো ও তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় (ষষ্ঠ ও ৭ম) সমবায়কে আর সেভাবে আনতে দেখা যায় না এবং পিআরএসপিএর দলিল থেকে সমবায়কে বাদ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণভাবে।

এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে সমবায় সংগঠনকে আবার সচল করার ডাক দেওয়া হয়। বিশেষত কৃষি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে সমবায়কে ব্যবহার করে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত জাপানে এর সফল দৃষ্টান্ত রয়েছে।  এক্ষেত্রে সফল উদ্যোক্তার প্রয়োজন যারা অঞ্চলভিত্তিক কৃষি পণ্যের উৎপাদনে নিবিড়তার নিরিখে বিপণন সমিতি গড়ে তুলবে উৎপাদকদের সহযোগিতায়। উল্লেখ্য, কৃষি পণ্যের বিপণনে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা দালাল, ফড়িয়া ব্যাপারীর মতো এক ধরনের  ভূমিকা পালন করে যা কৃষকের স্বার্থে যায় না। সে ক্ষেত্রে সমবায় সংগঠনের ভূমিকা জোরালো হতে হবে।

আমাদের দেশের উদ্যোক্তা কৃষকদের দৃষ্টি সমবায়ের প্রতি ফেরাতে পারলে তা অনেকাংশে সম্ভব হবে যদিও কাজটি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। এ রকম একটি উদাহরণ নিয়ে আসা হয়েছে নওগাঁ অ্যাগ্রো প্রজেক্ট’ নামের ব্যতিক্রমী কৃষি উদ্যোগ। সবুজ মননে, সবুজ সৃজন এই প্রতিপাদ্য ধারণ করে ২০১৯ সালে এই প্রজেক্টের শুরু হয়। শুরু থেকেই প্রজেক্টের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাবিব রতন। বেকার এবং প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে সমবায়ভিত্তিক এই প্রজেক্টে শুরুতে সঙ্গী ছিল ১৫ জন।

পরবর্তীতে ১০ জনের এই কৃষি উদ্যোগের অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতি শুরু হয় ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে। প্রতি মাসে একটি শেয়ার ১০০ টাকা হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে সংগ্রহ করা হয়। ১০০ শেয়ার ১০ জনের মাঝে সামর্থ্য বিবেচনা করে বণ্টন করা হয়েছিল। প্রতি মাসে ১০০ টাকার সঞ্চয়ে প্রান্তিক কৃষকদের সহজ অংশগ্রহণ ছিল এই উদ্যোগের একটি আলোকিত দিক। প্রায় ৬ মাস অর্থ সংগ্রহের পর গ্রামে দুই একর জমি ১০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে শুরু হয় মিশ্র ফল বাগান তৈরির কাজ। ব্যতিক্রমী এই প্রজেক্টে চায়না-৩ লেবু, বাউ-৩ ও বারি-১ জাতের মাল্টা, ড্রাগন ও থাই জাম্বুরার চারা লাগানো হয়। আধুনিক প্রযুক্তির মনন ও সম্মিলিত পরিশ্রমে অল্প সময়ের মধ্যে সুফলা নওগাঁ অ্যাগ্রো প্রজেক্ট মডেল মিশ্র ফল বাগান হিসেবে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

করোনা মহামারির সময়ে চায়না-৩ জাতের লেবুতে অভাবনীয় সাফল্য আসে। সে সময় বাজারে লেবুর চাহিদা ও দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় উপজেলার অনেক শিক্ষিত বেকার ও প্রবাসফেরত যুবকরা লাভজনক লেবু চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কৃষিতে আগ্রহী হয়ে ওঠা এসব যুবকের সার্বিক সহযোগিতা, পরামর্শ এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতে থাকে।

প্রজেক্টের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন ও নজরুল ইসলাম প্রতিদিন বাগানে কাজ করেছেন এবং বাগানের শেয়ারের মুনাফার টাকায় উন্নতি করেছেন। এ রকমভাবে এই প্রজেক্টে প্রায় ৬ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনেক মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রজেক্টের অর্থ সম্পাদক মোকাদ্দেস সরদার বছরব্যাপী লেবু, মাল্টা, ড্রাগন ইত্যাদি ফল বিক্রির কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। ব্যস্ততার সঙ্গে লাভের প্রাপ্তি মোকাদ্দেসকে কৃষিতে ভীষণ আগ্রহী করে তুলেছে।

২০২৩ সালে নতুনভাবে আরও দুই একর জমি লিজ নিয়ে নতুন করে বাগান তৈরির পরিকল্পনা করেন। এক একর জমিতে টিস্যু কালচারে উৎপাদিত সম্ভাবনাময় জি-৯ কলার বাণিজ্যিক বাগান তৈরির কাজ চলে। শুধু তাই নয়, সুফলা নওগাঁ অ্যাগ্রো প্রজেক্ট সূচনা থেকেই ‘ভার্মি কম্পোস্ট’ উৎপাদন শুরু করে। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্যান্য খামারিদের নিয়মিত জৈব সার ব্যবহারে জৈব সার বিপণন এবং উৎপাদনে কাজ করে চলেছেন।

প্রকল্পের পরিচালক হাবিব রতন জানান, ‘সুফলা নওগাঁ অ্যাগ্রো প্রজেক্ট’ উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে নিরাপদ ফল উৎপাদনে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করছে। দেশের উন্নয়নে যুব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাটি, জল, বায়ু ও পরিবেশের সমন্বয়ে সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

×