ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

চা শ্রমিক

বঞ্চনার অবসান কাম্য

সুমাইয়া আকতার

প্রকাশিত: ২২:১৫, ৫ অক্টোবর ২০২৪

বঞ্চনার অবসান কাম্য

চা শ্রমিক

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠার করুণ চিত্র ফুটে ওঠে চা শ্রমিকদের জীবনে। বর্তমানে চা বাগানের ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিকের জীবন সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং মজুরি বৈষম্যের শিকার। অথচ প্রতি বছর মে দিবস এলেই শ্রম আর শ্রমিকের নায্য অধিকার ও বৈষম্য নিরসন করার বিষয়ে লেখালেখি হয়, সভা-সমাবেশ হয়। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকদের বহু বছর যাবৎ শোষণ ও বঞ্চনা নিরসনের কার্যকরী পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচরহীন।

সমান কাজে সমান মজুরি দেওয়ার আইন থাকলেও চা শ্রমিকদের আজও ক্লাস বা ক্যাটাগরির নামে ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ করে যথাক্রমে ১৭০ টাকা, ১৬৯ টাকা ও ১৬৮ টাকা দৈনিক মজুরি দেওয়া হচ্ছে। অথচ ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকে। এ ছাড়া সমান কাজ করলেও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের মজুরি অনেক ক্ষেত্রে কম দেওয়া হয়। আবার পুরুষ শ্রমিকদের স্ত্রীকে তাদের ওপর নির্ভরশীল বিবেচনা করে রেশন দেওয়া হলেও নারী শ্রমিকের বেকার স্বামীকে নির্ভরশীল বিবেচনা করা হয় না। তাদের দেওয়া হয় না রেশনও।

যুগ যুগ ধরে চা শ্রমিকদের সঙ্গে এই অন্যায় চলে আসছে। এর ওপর যোগ হয় আবাসন, শিশুযতœ, বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য ভাতা। কিন্তু কাগজে লেখা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব সুবিধা তারা পান না। বর্তমান বাংলাদেশের ঊর্ধ্বগতির বাজারের সঙ্গে এই মজুরি কতটুকু বাস্তবসম্মত? শ্রমিকদের ৯৭ শতাংশেরই স্বাস্থ্যসম্মত কোনো প্রক্ষালন ব্যবস্থা নেই, সন্তান দিবা পরিচর্যা কেন্দ্রের সুবিধা নেই ৬৮ শতাংশের, আর শারীরিক, মৌখিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া তো সেখানকার নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই নিয়মিত ঘটনা।

অন্যদিকে পুষ্টি, শিক্ষা, সাধারণ স্বাস্থ্য সুবিধা ইত্যাদির মতো মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতিও যেন অবহেলিত। সারাদেশে কর্মরত চা শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। মৌলভীবাজার জেলায় মোট ৯২টি চা বাগানের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার নিয়মিত চা শ্রমিক কাজ করেন এই জেলায়। তাদের সিংহ ভাগই নারী। নারীর সমান অধিকার আজও যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। চা শ্রমিক পারভীন বেগম ও শেফালি কর বলেছেন, পেটের দায়ে যখন যে কাজ পাই সেটা করতে আমরা বাধ্য হই। তার পরও দেড়শ’ কিংবা দুইশ’ টাকা রোজ দেওয়া হয়।

এটি দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। আর পুরুষরা কাজ করলেই তিন থেকে চারশ’ টাকা পান। আমরা পুরুষদের চেয়ে কাজ কম করি নাকি। তবে পারিশ্রমিক কম পাই।  দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে ২০২২ সালের আগস্টে ধর্মঘট করেছিল চা শ্রমিকরা। সর্বশেষ গত বছরের ১০ আগস্ট চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে নি¤œতম মজুরি বোর্ড। চা শিল্পে নি¤œতম মজুরি বোর্ড অনিয়মিত ও চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে এ পর্যন্ত ৩ বার বোর্ড গঠন করেছে।

তবে এর ভূমিকা কখনো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কারণ বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে সই হওয়া শ্রম চুক্তি মোতাবেকই এতদিন মজুরি ঠিক হয়েছে।
চা বাগানে একটি আলোচিত বিষয় হলো- কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশ (৫ শতাংশ)। চা বাগানের মালিকরা কখনোই চা-শ্রমিকদের এ লভ্যাংশ দেননি। এখন নি¤œতম মজুরি বোর্ড গার্মেন্টস সেক্টরের মুনাফা দেওয়ার ব্যবস্থা চা-শিল্পে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি আরেকটি উদ্যেগের বিষয় হল, চা শ্রমিকদের গ্রাচুইটি থেকে বঞ্চিত করা। যা শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বরং গ্রাচুইটির পরিবর্তে যে পেনশন পান তা গ্রাচুইটির তুলনায় অনেক কম।

সপ্তাহে ২৫০ টাকা (২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা), যা ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিল ১৫০ টাকা এবং ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ২০ টাকা। গ্রাচুইটির বিষয়টি চাতুরতার সঙ্গে এড়াতে মালিক পক্ষ বলেছে যে, শ্রমিকদের অবসর গ্রহণের পর তাদের ঘর ছাড়তে হয় না। চা-শ্রমিকরা, যাদের পূর্ব পুরুষ চা বাগানে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন, যেভাবে এখনো এখানে বন্দি জীবনযাপন করছেন, ঠিক সেভাবেই বাকি শ্রমিকদেরও কুণ্ঠিত করছেন মালিক পক্ষ।

এ ছাড়াও ৯৭ শতাংশ চা শ্রমিকদের নেই কোনো স্থায়ী নিয়োগপত্র। স্থায়ী নিয়োগপত্র ছাড়াই নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। পক্ষান্তরে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের দিকে তাকালে দেখা যায় উন্নয়নের নামে ও কাজে নিজেদের আত্মীয়স্বজন, স্বগোত্রীয় ও স্বশ্রেণির মানুষের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যন্ত গ্রামের, পাহাড়ের, মুচিপল্লীর, কামারশালার তথা নি¤œ আয়ের, নি¤œ পেশার, নিম্ন শ্রেণির প্রান্তিক মানুষ কি তা হলে রাষ্ট্র স্বীকৃত সুবিধাপ্রাপ্তিযোগ্যদের তালিকায় পড়েনি।

যদি পড়ে তা হলে যে সুবিধাভোগীদের খাতায় উল্লিখিত প্রান্তিক মানুষ বরাবর প্রান্তিকই রয়ে যাচ্ছে, তার ব্যাখ্যা চায় বর্তমান সমাজ। ওই যে সুবিধাভোগীদের পদভারে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, তাদের কণ্ঠের দরাজ শব্দে সব টেলিভিশনের পর্দা, তাদের গগনবিদারী আওয়াজে সব জনপদ নিরন্তর প্রকম্পিত হয়ে উঠছে, সেখানে শেষোক্ত ওই প্রান্তিক মানুষ নেই কেন? কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চা শ্রমিকদের উত্তরসূরিদের মজুরি নিয়ে আজও রাস্তায় নামতে হয়?  কেন গরিব শুধু গরিব আর ধনী শুধু ধনী হওয়ার সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করছে তা এখন প্রকাশ্য।
রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে এবং সংস্কারে এই প্রান্তিক গোষ্ঠীর আহাজারি, অধিকার ও শ্রম শোষণের দিকে দৃষ্টিপাত করে বাংলাদেশকে আর গতিময়তার দিকে প্রশস্ত করতে হবে।

×