ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

তারল্য-সহায়তা এবং দুর্বল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ 

রেজাউল করিম খোকন

প্রকাশিত: ২২:১৩, ৫ অক্টোবর ২০২৪

তারল্য-সহায়তা এবং দুর্বল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ 

ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ

ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ। দেশের পুঁজিবাজার দুর্বল, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতও শক্তিশালী নয়, সে কারণে অর্থের ৯০ শতাংশই আসে ব্যাংক খাত থেকে। স্বাধীনতার পর দেশে উদ্যোক্তাশ্রেণি তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ আছে। সরকার শক্ত হাতে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। দেশের মানুষের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, মূল্যবোধও কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতের লোকজনদের মধ্যে এটি প্রকট।

খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যাংকিং খাতে অনেক ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ক্যামেলস রেটিং অনুসারে ব্যাংকের স্বাস্থ্য পরিমাপের যেসব সূচক, যেমন মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, খেলাপি ঋণ, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপালিত হয় না। যদিও আলোচনা কেবল খেলাপি ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মূলধনের পর্যাপ্ততা বড় সমস্যা।

আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা ব্যাসেল অনুযায়ী যে পরিমাণ মূলধন থাকার কথা, তা কিন্তু সবাই মানতে পারে না। বিশেষ করে ১০-১২টি ব্যাংকের এই মূলধন অপর্যাপ্ত আছে। 
সংকটে পড়া সাত ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার তারল্য-সহায়তা চেয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ৫ হাজার কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৯০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার কোটি ও এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্নীতির কারণে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইতোমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। এর সব কটি ব্যাংক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে যান।

এরপর গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি যোগ দিয়েই ব্যাংক খাতের সংস্কারে মনোযোগ দেন। গত ২০ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক তারল্য-সংকটে ভুগছে। তবে ছয়টি ব্যাংকের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের অনেক শাখায় নগদ টাকার লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমানতকারীদের চাপে শাখা ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা প্রতিদিনই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।

গ্রাহকেরা প্রয়োজনে দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে সমস্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, এমন ১০টি ব্যাংক আর্থিক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। তাদের এই ঋণে গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিনের মধ্যে টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি ও বাজারভিত্তিক সুদ চেয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের টাকা ফেরত চাইলে সবল ব্যাংকগুলোকে তিন দিনের মধ্যেই তা ফেরত দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কোনো ব্যাংক ঋণ দেওয়ার জন্য কোনো টাকা নিতে পারবে না। কোনো ব্যাংককে কত টাকার তারল্যসহায়তা দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দুই ব্যাংকের সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত তারল্য থাকা যে ১০ ব্যাংক ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ব্র্যাক, ইস্টার্ন, দি সিটি, শাহ্জালাল ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, সোনালী, পূবালী, ঢাকা, ডাচবাংলা ও ব্যাংক এশিয়া।

ধার নেওয়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যক্তি আমানতকারীরা টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন। এই টাকা দিয়ে অন্য ব্যাংকের ধারের টাকা শোধ করা যাবে না। ব্যাংকের আগের বা বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের কেউ জমানো টাকা তুলতে পারবেন না। নতুন করে কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। ডলার কেনার কাজেও এই টাকা খরচ করা যাবে না।
পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ক্ষুদ্র ও বড়, সব ধরনের আমানতকারী টাকা তোলার জন্য ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছেন। এতে বেশিরভাগ ব্যাংকে তারল্যসংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে এবং সবাই টাকা পাচ্ছেন না। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া চলতি হিসেবে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় কয়েকটি ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব ব্যাংকের গ্রাহকেরা এটিএম বুথ থেকেও টাকা তুলতে পারছেন না। এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক খাত রুগ্ন হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তা বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। যত রুগ্নই হোক, কোনো ব্যাংককে শেষ হতে দেবেনা। এ বিষয়ে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া দরকার। সেই সঙ্গে শক্তিশালী ব্যাংক কোনগুলো, তা বলা উচিত। রুগ্ন ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও এর প্রভাব পড়ে।

এ খাত মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ তৈরি হয়, অর্থাৎ পুরো বিষয়টি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভালো ব্যাংকও যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। সে জন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার বার্তা থাকা উচিত, কোনো ব্যাংকগুলো কী অবস্থায় আছে। ১০-১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করে দেওয়ার পর এসব ব্যাংকের এখন নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে। প্রতিদিন আমানত, ঋণ, ঋণপত্রসহ (এলসি) ২০টি সূচকের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। স্বস্তির বিষয় হলো, এত কিছুর পরও এসব ব্যাংকে ৮০০ কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। মানুষ এখন এই ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা করছেন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এসব ব্যাংককে কিভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তা দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন হবে না। ফলে সহায়তার আকার অর্ধেক কমে গেছে। এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন। এক বছর সময় দিলে এই ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। তবে গ্রাহকেরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। ব্যাংক খাতের সংস্কারে আগে কমিশন করার দরকার ছিল। কিন্তু এখনই কমিশন করলে ছয় মাস সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করে কাজ শুরু করলে তা অনেকটা এগিয়ে যাবে। তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে, ইতোমধ্যে একটি গঠন করা হয়েছে।

ব্যাংক আইন সংস্কার এখনই হবে তা নয়। তিন টাস্কফোর্সের সুপারিশের পর আইন পরিবর্তনের জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে। দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কমে আসুক, এটা আমরা সবাই চাই। বিশ্ববাজারে এসব ব্যাংকের কোনো দাম নেই। অনেক দেশে ৬০টি ব্যাংক ছিল, তা ১৫টিতে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু দেশে এমন কিছু করতে হলে স্থানীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় আছে। ব্যাংক একীভূত বা অধিগ্রহণ স্বেচ্ছায় হলে ভালো। না হলে সরকারি পর্যায়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দেশ পুনর্গঠন হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গঠন একটি ভালো উদাহরণ। এ জন্য সময় প্রয়োজন হবে। এক-দুই মাসে এসব বাস্তবায়িত হবে না। যারা ভালো ব্যাংক, তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা দেয়। দুর্বল ব্যাংককে কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে, শর্ত কী, এসব নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। ব্যাংকগুলো কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই দুর্বল ব্যাংককে ঋণ দিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কোনো ব্যাংক অর্থ ফেরত দিতে না পারলে গ্যারান্টার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যাবে। এটা খুবই বিব্রতকর হবে যে অর্থ ফেরত চাইতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই  সুখকর পরিবেশ তৈরি করবে না। এখন প্রশ্ন, এভাবে  তারল্য-সহায়তা দিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব?

×