ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

অর্থনীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে

বেকারত্ব

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বেকারত্ব

একটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে দেশের কর্মজীবী মানুষ

একটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে দেশের কর্মজীবী মানুষ। প্রতিটি মানুষ যখন উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত থাকে তখন দেশের প্রবৃদ্ধির গতি ঠিক থাকে। বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছে। এর আগে বেকারত্ব কিছুটা কমলেও উচ্চ শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছিল।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা  কমেছে প্রায় পৌনে ১১ লাখ। এ সময় শ্রমশক্তি হিসেবে কাজে যোগদানে যোগ্য মানুষের সংখ্যা কমেছে ৯ লাখের বেশি। সার্বিক বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৪১ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজারে নেমে এসেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার। এ হিসেবে এক বছরে কর্মসংস্থান কমেছে ১০ লাখ ৭০ হাজার। 
বেকারত্ব এবং অর্থনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দেশের অর্থনীতির উত্তরণের প্রধান বাধা বেকারত্ব। বেকারত্বের প্রকারভেদ ধরলে প্রথমেই আসে শিক্ষিত বেকারত্ব যা বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়াও ছদ্ম বেকারত্ব এবং মৌসুমি বেকারত্বও রয়েছে প্রকট হয়ে। বিভিন্ন মৌসুমে কাজ না থাকা সমস্যা। আবার প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলেও এসব ছদ্ম ও মৌসুমি বেকারত্ব বাড়ছে।

তবে মূল সমস্যা হলো উচ্চ শিক্ষিত বেকারত্ব। জনসংখ্যা নিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের তত্ত্ব বলছে, কোনো দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা; তার সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উপযুক্ত কাজের সুযোগ তৈরি হয়, তাহলে মোট জাতীয় আয় বা উৎপাদন বৃদ্ধির সূচকও হবে ঊর্ধ্বমুখী, উন্নয়নের সুফল মিলবে ঘরে ঘরে। কিন্তু কর্মক্ষম মানুষের সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না দেশ।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমাদের সামনে এই সংকটকে আরও বেশি তীব্র করে তুলেছে। যে হারে বা যে সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর লেখাপড়া শেষ করে কাজের বাজারে যুক্ত হয় তার অল্পসংখ্যকই চাকরির বাজারে টিকতে পারছে। উচ্চ শিক্ষা চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এক সময় যেমন ভাবা হতো যে, লেখাপড়া শেষ করলেই অন্তত পক্ষে একটা চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে, আজ আর সেই ধারণা নেই।

লেখাপড়া শেষ করাটাই বরং অনেক বেশি সহজ। বিপরীতে চাকরি পাওয়াটা সোনার হরিণের থেকেও বেশি কিছু। এ অবস্থা কেবল আমাদের দেশে বিরাজ করছে তা কিন্তু নয়, বরং করোনা বিশ্বের ধনী দেশগুলোকেও আজ এই বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের (স্নাতক পাস) সংখ্যা ছিল প্রায় আট লাখ।

বুধবার (২৬ অক্টোবর) প্রকাশিত বিবিএসের ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছেন প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ। ২০১৬-১৭ সালে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ।

অর্থাৎ আগের তুলনায় বর্তমানে দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়েছে। বিবিএস জরিপের তথ্যমতে, ২০২২ সালের উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে নারী ছিল প্রায় ১৯ শতাংশ। অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামূলক কম। 
এখন যত সংখ্যক ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারে পা রাখছেন তত সংখ্যক চাকরি খালি নেই। আবার এর মধ্যেও আছে বিভাজন। যার টাকা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো তার চাকরি হচ্ছে, মেধাবীরা বাদ পড়ছেন। এসব নানা কারণে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গেহ এসব বেকারের চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা বিরাজ করছে।

উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতীর চাপ কেমন তা বোঝা যায় এক একটি সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে। প্রতি বছর আবেদনকারীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেই অনুমেয় যে, একটি চাকরির জন্য কত সংখ্যক বেকার ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করছেন। অবশ্য এদের প্রত্যেকেই বেকার এমন নয়। কারণ কেউ কেউ প্রাইভেট চাকরি করছেন। কিন্তু করোনায় প্রাইভেট চাকরির অবস্থাও খারাপ।

সেখানে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে, বেতন বকেয়া রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর চেয়েও বড় কথা, বেসরকারি চাকরির প্রতি এখন বেকারদের ঝোঁক কম। কারণ সরকারি চাকরির বেতন, সুযোগ-সুবিধা এবং নিশ্চয়তা বেশি। দেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার জন্য পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বহুসংখ্যক প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। যদিও তার অনেকটিরই মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

নিজস্ব ক্যাম্পাসসহ অনেক শর্তই পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বেকার সমস্যা আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা। প্রতিটি নাগরিকের কাজ নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। একসময় বলা হতো, লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে।’ এ কথা আজকের সমাজে ধ্রুব সত্য নয়। যে লেখাপড়া করছে সে কি তিন বেলা খেয়েপরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাচ্ছে? শিক্ষিত বেকারের কষ্ট আরো বহুগুণে বেশি।

লেখাপড়া শেষে চাকরি না জোগাড় করতে পারলে তার পরিবার এবং সমাজের কাছে হেয় হতে হয়। চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর যখন একজন চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নামে তখন কতজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক শেষ পর্যন্ত সফল হচ্ছে? আমরা কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছি তবে এই প্রক্রিয়ায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে আরও বেশি সময়ের প্রয়োজন। তা ছাড়া আইসিটিতে দক্ষ নাগরিক গড়ে না তুলতে পারলে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় না।  
উচ্চ শিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। অনেকেই আছেন যারা পড়ালেখা শেষ করার পর কয়েকটি বছর কেবল চাকরি খুঁজেই কাটিয়ে দেন। তারপর চাকরির বয়স শেষ হলে কোনো কাজ বা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন। সরকারি চাকরির সুযোগ খুব বেশি নেই। ফলে প্রধান ভরসা বেসরকারি খাত। কিন্তু সেই খাতেও নতুনদের আসতে নানা বাধা। ফলে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও একজন তরুণ বেকার থাকছেন। 
উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে কেউ বেকার বসে থাকতে চান না। কিন্তু বেকার থাকতে হয়। ক্রমেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা তাদের মেধা দিয়ে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবেন তাদের কর্মহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানো হতাশার। এসব শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মমুখী করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এর মধ্যে অন্যতম হলোÑ এই প্রজন্মকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা। 
ফ্রিল্যান্সিংসহ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে নিজের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেওয়া সম্ভব। শিক্ষিত এই প্রজন্মকে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। উন্নত দেশ গড়তে বেকার সমস্যা সমাধানে কাজের উপযুক্ত ক্ষেত্র গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

×