ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

প্রয়োজন খাদ্য নিরাপত্তা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রয়োজন খাদ্য নিরাপত্তা

প্রতিটি মানুষের জন্য সুষম খাদ্যের নিরাপত্তা সরকারের

প্রতিটি মানুষের জন্য সুষম খাদ্যের নিরাপত্তা সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার একটি অগ্রাধিকার বিষয় হলেও যে কোনো দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড় কিংবা বন্যায় তা আলোচনার প্রথম সারিতে চলে আসে। বর্তমান চলমান বন্যায়ও এই দৃষ্টিভঙ্গির কোন ব্যাপ্তি নেই। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী দেশ আকস্মিক বাঁধ ছেড়ে দেওয়ার ফলে বন্যায় তলিয়ে যায়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকিয়ে রেখে দেশের নদীসমূহ শুকিয়ে মারা হয়।

পৃথিবীর কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো পানি আগ্রাসনের শিকার হয় না। আমাদের দেশের সমতলভূমির পাশেই ভারতের পাহাড়ি এলাকা। সেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির সব পানি বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে চলে আসে। এর ফলে বাংলাদেশ বন্যাকবলিত হয়। উপরন্তু পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে ভারত তার প্রয়োজনে পানি আটকিয়ে রাখে আর অতিবৃষ্টি হলে বাঁধ ছেড়ে দেয়।

বাংলাদেশে এক সময় ১২শ’র বেশি নদী ছিল কিন্তু এখন ২০০ নদীও সচল নেই। সব শুকিয়ে চিকন মরা খালে পরিণত হয়েছে। চিহ্নই থাকছে না। আমাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তর্জাতিক নদীর সকল নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করছে।

রাজশাহীর পশ্চিম সীমান্তে অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার ১৯ মাইল উজানে মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে ভারত ১৯৬১ সালে বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করে এবং ১৯৭৪ সালে ফিডার কেনেলসহ নির্মাণকাজ শেষ করে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে শীত মৌসুমে ৪৭ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকত এখন তা শুধুই অতীত, ফলে বাংলাদেশের নদী এখন মরুভূমি যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। 
কিন্তু প্রশ্ন থাকে এই বিষয়টির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যের প্রাপ্যতা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, খাদ্য আমদানি, খাদ্য সাহায্য এবং খাদ্যের মজুত; দ্বিতীয়ত খাদ্যের প্রবেশাধিকার যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য ক্রয়ের সক্ষমতা এবং তৃতীয়ত খাদ্যের সঠিক ব্যবহার। আমরা যদি প্রথমটির বিশ্লেষণে যাই তা হলে দেখা যায় যে, নতুন অর্থছরের শুরুতে দেশের দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলীয় বারোটি জেলায় অকাল বন্যায় আমন ধানখেত একেবারে পানিতে তলিয়ে গেছে যা দেশের সামগ্রিক খাদ্য ভা-ারে একটি বিশাল ঘাটতির সৃষ্টি করবে।

অপরদিকে সেই অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিনামূল্যে চাল বিতরণ, দারিদ্র্যবান্ধব চাল কর্মসূচি ইত্যাদির কারণে সরকারের চাল মজুতের পরিমাণ হ্রাস  পাবে। অপর দিকে সরকারের চাল সংগ্রহ অভিযান তেমন সফল হয়নি। বিশেষত চালকল মালিকদের অসহযোগিতার কারণে। দেখা যায় চালের সরকারি মজুত গত মার্চ মাসে ৬ লাখ টনের নিচে নামলে চাল ব্যবসায়ী / চালকলের মালিকরা চালের মজুত শুরু করে।

গত এপ্রিলে সরকারি গুদামে চালের মজুত ছিল ৩ লাখ টনের নিচে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জুন-জুলাই মাসে কমপক্ষে ১৫ লাখ টন চাল খাদ্য গুদামে মজুতের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করার ফলে খুচরা বাজারে রমজানের ঈদের আগে-পরে কয়েক দফায় চালের দাম বেড়েছে প্রকার ভেদে ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত যা এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে।

সরকারের চাল আমদানির পদক্ষেপও দামের পতন ঘটাতে সহায়ক হয়নি। আমরা যদি দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিতে আসি তা হলে দেখা যাবে যে, খাদ্য ক্রয়ের সক্ষমতা স্বভাবতই বন্যার্তদের মধ্যে থাকবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পুনর্বাসিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যোগদান করতে পারবে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক খাদ্য যেমন- চাল, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ প্রভৃতির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

এরই মধ্যে ২৪ আগস্ট শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এ আহ্বান জানান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বন্যা মোকাবিলাকে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশবাসীকে তা মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

অব্যাহত বন্যার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি অংশ যার সঙ্গে শস্য উৎপাদন জড়িত তা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলছে এবং দেখা দিয়েছে চাল ও সবজির ঘাটতির, এরপর শুরু হবে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় উৎসব যেখানে চাল ও সবজির একটা বড় চাহিদা থাকবে। এই পরিস্থিতি সরকারকে যদি মোকাবিলা করতে হয় তবে খাদ্য আমদানি জোরদার এবং বিতরণ ব্যবস্থা সুসংহত করতে হবে।

একই সঙ্গে যে সব এলাকার পানি সরে গেছে সে সব এলাকায় কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি বিশেষত আমনের বীজতলা তৈরি, সবজির বীজতলা তৈরি ইত্যাদি কাজ শুরু করে দিতে হবে যাতে আমন ধানে বিলম্ব হলেও কৃষকের ঘরে তুলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করা যায়। যে সব গবাদিপশু বেঁচে গেছে তাদের সুরক্ষা, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ঋণ সহায়তা দেওয়া, যে সব মৎস্য খামারির মাছের ঘের বন্যায় ভেসে গেছে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদি পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রাধিকারভুক্ত কাজ হতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক কর্মকা-গুলো তাদের আয়ের পথে সহায়ক হতে পারে।

এখন অর্থনৈতিক কর্মকা-গুলো সংগঠিত করার জন্য তাদের আশ্রয়স্থল বাসস্থান মেরামত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে। আশা করি, বন্যার্তদের মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য সামাজিক সংগঠনগুলো উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি হাতে নেবে যাতে তাদের ভরসার জায়গাটি আবার পুনঃস্থাপিত হতে পারে। অনেক গবেষক মনে করেন সরকারের টার্গেট খাদ্য কর্মসূচি অভীষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সঠিকভাবে পৌঁছায় না এবং যা পৌঁছায় তা অপ্রতুল বলে প্রতীয়মান।

সেই অবস্থার মোকাবিলায় যা করতে হবে তা হলো : প্রথমত বন্যার্তদের ত্রাণ কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত চালের বাজারে সম্ভাব্য কারসাজি কঠোর হাতে দমন করতে হবে। তৃতীয়ত  সরকারি গুদামে চালের মজুত দ্রুত বাড়াতে হবে এবং আমদানি ও অভ্যন্তরীণ কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তারা খাদ্য ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী, কথা দিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে বানভাসি গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলোকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি আর বেসরকারি সংগঠন তার সহযোগী।

খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার আর তা নিশ্চিত করতে হবে মানবিকতার সঙ্গে, ব্যবসা দিয়ে নয়। এ ব্যাপারে সামাজিক উদ্যোক্তাদেরও ভূমিকা কম নয়। তবে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি যেহেতু খুব স্পর্শকতার তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অনুশীলন করবে এবং তথ্য প্রবাহের ব্যাপারে স্বচ্ছ হবে। এ ব্যাপারে খাদ্য-বাণিজ্য-অর্থ এই তিনটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করবে- এটাই প্রত্যাশা।

×