ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

 সমৃদ্ধ হোক পর্যটন শিল্প

জলি রহমান

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 সমৃদ্ধ হোক পর্যটন শিল্প

 সমৃদ্ধ হোক পর্যটন শিল্প

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলোর মতোই অনুভূতি হয়েছিল প্রায় এক যুগ পরে নিজ গ্রামে গিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি শুধু চোখকেই প্রশান্তি দেয় নি। মনে হয়েছিল এখানেই কাটিয়ে দেই সারাটি জীবন। যদিও কর্মের প্রয়োজনে আবার ফিরে আসতে হয়।

বাড়ির খুব নিকটবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে ছৈলারচর নামক পর্যটন স্পট। কি নেই সেখানে? রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশ্রামাগার। প্রচুর ছৈলা গাছ, এক পাশে নদী, আরেক পাশে খাল ও শান বাঁধানো ঘাট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেই ছৈলারচরে বছরের দুই ঈদে প্রচুর পর্যটক থাকলেও অন্যান্য সময়ে খুব একটা মানুষের আনাগোনা থাকে না।

নদীমাতৃক আমাদের এ দেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা সৌন্দর্যম-িত পর্যটন স্পট। যা অবহেলায় অনাদরে কারও দৃষ্টিগোচর হয় না।  পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বর্তমানে অনেক সমৃদ্ধ। অথচ আমাদেরও এমন সুযোগ রয়েছে। শুধু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের অভাবে দেশের পর্যটন শিল্প তুলনামূলকভাবে রয়েছে অনেক পিছিয়ে। 
বাংলাদেশে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, পতেঙ্গা, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। তবে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এসব জায়গা প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হলেও যোগাযোগ, নিরাপত্তা, খাবার দাবার নিয়ে নানা রকম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এখানকার চা-বাগান, জাফলং, লালাখাল, বিছনাকান্দি, ঝরনা, রাতারগুল, হাকালুকি ও কানাইঘাটের সৌন্দর্য হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসুকে আকৃষ্ট করে। ফলে, এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকার নতুন খাত হিসেবে পর্যটনকে বেছে নিয়েছে।

এছাড়াও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাত জেলার অসংখ্য হাওড় নিয়ে বিশাল পর্যটন অঞ্চল তৈরি করা যায়। সেখানে হাওড়ভিত্তিক পর্যটন বিকশিত হলে বর্ষাকালে অলস বসে থাকা ভাটি অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
একজন পর্যটক ১০ জনের কর্মসংস্থান করতে পারে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর অবদান বিশ্ব জিডিপির ১১ শতাংশ, বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের ৯ শতাংশ, বৈশ্বিক রপ্তানির ১২ শতাংশ এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগের ১১ শতাংশ। পর্যটন শিল্প অর্থনীতিতে টেকসই ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সমাজের সব শ্রেণির জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, পর্যটন অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে। দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। এই শিল্পকে উন্নত করে দেশের বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। তবে ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে এই বিপুল সংখ্যার ৭৩ শতাংশই আবার ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এই বিশাল বাজার ধরতে পারে  তবে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশের প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে থাকে। দেশে ২০১৯ সালে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। যার ফলে ১৪০টি দেশের মধ্যে ১২৫তম স্থান থেকে ১২০ এ পৌঁছায়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু পাকিস্তানই বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে।

তবে পর্যটন আয়ের বেশিরভাগই আসছে দেশীয় উৎস থেকে। কেননা বিদেশী পর্যটকের কাছে আমাদের পর্যটন শিল্পের জনপ্রিয়তা এখনো অনেক কম। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও পর্যটন স্পটে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। দীর্ঘ যানজটের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নেই পর্যাপ্ত হোটেলের সুব্যবস্থা। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সুপরিকল্পিত আধুনিকায়ন ও শুল্কমুক্ত বিপণির অভাবও এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। বর্তমানে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মাধ্যমে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ প্রাকৃতিক রূপ অবলোকন করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কোনো প্রচার নেই বললেই চলে। প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কথা তুলে ধরার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও সম্ভব।
বিদেশী পর্যটকদের কাছে সুরক্ষা ব্যবস্থা একটি বড় ইস্যু। চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানি, সহিংসতা থেকে পর্যটকদের রক্ষা করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। দিতে হবে নির্বিঘেœ চলাফেরার নিশ্চয়তা। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তারা এ দেশের প্রতি আকৃষ্ট হবে। দক্ষ ও মার্জিত জনবলের অভাব এ শিল্পের একটা বড় সমস্যা। সেই সঙ্গে রয়েছে উন্নত ও দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব।

আবার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে উন্নত দেশের তুলনায় পর্যটনের ব্যয় তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। বাড়তি যাতায়াত খরচ থেকে শুরু করে হোটেলগুলোর উচ্চমূল্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় প্রায়ই। এটি অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। কেননা এর চেয়ে কম ব্যয়ে ভালো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে অন্য দেশগুলো।

বিশ্বব্যাপী পর্যটন বাজারের ৫৩ শতাংশ আসে আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে। যা থেকে আমরা অনেকটাই বঞ্চিত। এশিয়ার বাইরে থেকে আসা পর্যটকের হার শতকরা ২০ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ। যেখানে আমাদের দেশে এ হার মাত্র ৭ শতাংশ। পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করছে থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপালের মতো দেশ।

পর্যটন আকর্ষণে পিছিয়ে নেয় দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও। সঠিক প্রচার ও রক্ষনাবেক্ষনের মাধ্যমে আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রয়োজন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ। দেশকে এগিয়ে নিতে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ শিল্প খাত উন্নত করা সময়ের দাবি।

×