ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

জুলাই-আগস্ট

রাজনৈতিক অস্থিরতায় এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:২৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক অস্থিরতায় এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে

রাজনৈতিক অস্থিরতায় এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে

দীর্ঘ সময় ধরে চলা ডলার সংকট এখনো কাটেনি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। ডলারের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে দেশে পণ্যের আমদানি এলসি বা ঋণপত্র খোলার পরিমাণ এবং এলসি দায় নিষ্পত্তি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী ডলারের অভাব ছাড়াও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এলসি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

গত জুলাই মাসজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের কারণে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকা এবং ব্যাংকে সাধারণ ছুটি এলসি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে। এরপর গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকের মালিকানায় ব্যাপক পরিবর্তনসহ সার্বিক ব্যাংক খাতের অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কার্যক্রম কিছুটা হলেও থমকে গেছে। তবে পরিস্থিতির দ্রুতই উন্নতি হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের ব্যাংকগুলো ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আলোচিত সময়ে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিল্পের কাঁচামাল ছাড়া সব খাতের এলসি খোলার অঙ্ক কমেছে।

জুলাই-আগস্ট মাসে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া মূলধনি যন্ত্রপাতি ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ, ইন্টারমিডিয়েট গুডস বা মধ্যবর্তী পণ্য ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, জ্বালানি ৩৬ দশমিক ২০ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি কমেছে ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
অপরদিকে গত জুলাই-আগস্ট মাসে আমদানি এলসির নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ শতাংশ। আলোচিত সময়ে ব্যাংকগুলো আমদানি এলসির পেমেন্ট করেছে ১০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে পেমেন্ট করেছিল ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সব খাতের পণ্যের আমদানি নিষ্পত্তি কমেছে। ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

এ ছাড়া মূলধনী যন্ত্রপাতি ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, ইন্টারমিডিয়েট গুডস ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, জ্বালানি ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি দায় নিষ্পত্তি কমেছে ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। 
পরিসংখ্যান বলছে, আগের তুলনায় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম ছিল কম। কিন্তু এর প্রভাব তেমন পড়েনি দেশের আমদানিতে। কারণ গত অর্থবছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ছিল ডলার সংকট। চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় পণ্য আমদানি তেমন হয়নি।

বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ সামান্য বেড়েছিল; যা তার আগের তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। তবে এলসি খোলার পরিমাণ সামান্য বাড়লেও নিষ্পত্তি কমেছিল প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডলার সংকটের মধ্যেও ৬ হাজার ৮১৯ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছেন দেশের আমদানিকারকরা। এ হিসাব আগের অর্থবছরের তুলনায় ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৯৫ কোটি ডলার।

তবে তারও আগের বছর এলসি খোলার পরিমাণ আরও বেশি ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ হাজার ৪২৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। অপরদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এলসি নিষ্পত্তি কমেছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, ডলার সংকটে আমদানি ব্যয় কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দেড় বছর ধরে আমদানি এলসি খোলায় শতভাগ মার্জিন রাখা, বিলাসদ্রব্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করাসহ অনেক পদক্ষেপই নিয়েছে। এতে আমদানি কমে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ট্রেড ও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সের উন্নতি হলেও সরকারি ও বেসরকারি ঋণ পরিশোধের চাপ ও ট্রেড ক্রেডিট বাড়ায় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি দিনদিন খারাপ হচ্ছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, সংকট কাটাতে আমদানিতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে; যা সম্প্রতি বন্ধ করা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে উল্টো ফল বয়ে এনেছে। ডলার সংকটের এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কমছে মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি।

এর মানে দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান কমছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া সহজ হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে ব্যাংকগুলো এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ১১৮ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে। এ ছাড়া রেমিটেন্সের ডলার সংগ্রহ করছে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে। রেমিটেন্সের সঙ্গে আরও আড়াই শতাংশ সরকারি প্রণোদনা যুক্ত হচ্ছে। ক্রলিং পেগ ঘোষণার পর গত কয়েক মাস ধরে ডলার বাজার স্থিতিশীল আছে।

×