ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ

অর্থনীতি ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:৫১, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ

ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিট

ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিট, যাকে আর একটু প্রসারিত করে বলা যায় ক্ষুদ্র অর্থায়ন বা মাইক্রোফাইন্যান্স। ক্ষুদ্রঋণ গরিব মানুষদের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর্থিক সেবা দেয়, যা নিবিড় তদারকির আওতায় জামানতবিহীন ঋণ প্রদান সেবা। ক্ষুদ্র ঋণের উত্থানের সঙ্গে বাজার অর্থনীতির এবং গ্রামীণ আর্থিক খাতের বিবর্তনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বিগত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রামীণ আর্থিক খাতের বিষয়ে চিন্তাভাবনার জগতে যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তার ঢেউ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আর্থিক খাতকেও প্রভাবিত করেছে। ৬০-এর দশকে গ্রামীণ আর্থিক খাতকে দেখা হতো অনেকটা উন্নয়ন কর্মকা- হিসেবে, মনে করা হতো গ্রামের গরিব মানুষকে ভর্তুকি দিয়ে ঋণ দিতে হবে, তারা সঞ্চয় করতে সক্ষম নয়।

অতএব, ওপর থেকে ঢেলে দেওয়া আর্থিক সহায়তাই এখানে উৎপাদন বাড়ানোর কার্যকর পদ্ধতি। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ধারণা বদলাতে শুরু করে, জোর দেওয়া হয় সঞ্চয়ের ওপর, সরবরাহভিত্তিক সেবার বদলে চাহিদাভিত্তিক সেবা গুরুত্ব পায় এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর টেকসই বিষয়টিতে নজর দেওয়া হয়, অর্থাৎ কর্মকা- হতে হবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে।

শুরুতে ক্ষুদ্র ঋণের প্রায় শতভাগ অর্থের জোগান বিদেশী সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে হলেও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের তহবিলের পরিমাণ কমতে থাকে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দেখা যায়, টেকসই প্রতিষ্ঠানের ধারণা গুরুত্ব পেতে থাকে। এভাবে ক্ষুদ্রঋণকে ক্রমান্বয়ে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে বাণিজ্যিকীকরণ ও প্রসারিত করার মাধ্যমে এর ‘প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 
বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণের ‘জন্মভূমি’, মানুষের দারিদ্র্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এর সূচনা। এরই হাত ধরে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘নোবেল প্রাইজ’ আসে, যদিও ‘ক্ষুদ্রঋণ’ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আলোচনায় গুরুত্ব পেতে থাকে ৯০-এর দশক থেকেই। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ ঘটেছে প্রধানত দুটো ভিন্ন ধারায়, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে।

এর প্রথম ধারাটিকে বলা যায় আবির্ভাব পর্ব এবং পরবর্তী ধারাটিকে বলা যায় বিস্তার পর্ব। প্রথমটি আসে গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে, দরিদ্র মানুষদের মালিকানাভিত্তিক একটি নতুন ধারার ব্যাংক সৃষ্টির মাধ্যমে। আর দ্বিতীয় ধারাটি তৈরি হয় এনজিওদের মাধ্যমে। প্রথমটির প্রকাশ আশির দশকের গোড়ায়, দ্বিতীয়টির বিকাশ নব্বইয়ের দশকে। গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টিকে বলা যায় ব্যক্তি উদ্যোগে স্থানীয় উদ্ভাবন, যদিও এখানে সরকারি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা ছিল। 
অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতোই এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রান্তিক জনগণের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সব শ্রেণির মানুষের আর্থিক সেবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকরা একটি জুতসই পদ্ধতি অনুসন্ধান করতে থাকলেও এর কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না।

একদিকে দরিদ্র জনগণের পক্ষে ব্যাংকের শর্ত পূরণে অক্ষমতা, অন্যদিকে অনুন্নত এলাকায় স্বল্প আয়ের জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য ব্যাংকের খরচ ও ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সমস্যা। এ উভয় সংকট বিবেচনায় স্বল্প খরচে দরিদ্র মানুষের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবা পৌঁছার কাজটি সব দেশের জন্যই চ্যালেঞ্জিং। 
বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের গ্রামীণ আর্থিক খাতে কী ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং সেখানে ক্ষুদ্রঋণের বাজার কতটা বিকশিত হয়েছে, তার কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ড. মাহবুব হোসেন এবং আব্দুল বায়েস ১৯৮৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ১৯৮৮ সালে গ্রামীণ আর্থিক বাজারের ২০ দশমিক ৭ শতাংশ সেবা দিত ব্যাংকগুলো, ৩৯ শতাংশ মহাজনরা, ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ আত্মীয়স্বজন এবং মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের, যা মূলত ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের।

২০ বছরের ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে যে, এর ৩৭ শতাংশ সেবা দিচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং মাত্র ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ মহাজনরা। বাংলাদেশ সরকারের বিবিএসের রুরাল ক্রেডিট সার্ভে ২০১৩ আরও গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান দেয়। সেখানে দেখা যায়, ব্যাংকের অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে, মহাজনদের ৬ শতাংশ, আত্মীয়স্বজনদের ৩ শতাংশ এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ ।

এ তথ্য থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, মহাজনদের এবং স্বজনদের ঋণের একটা বড় অংশ চলে গেছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। এ সময়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থার তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না। অতএব, বলা যায়, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোই বর্তমানে পল্লী অঞ্চলে প্রধান ঋণ সরবরাহকারী। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা এমএফআইগুলো কাজ করে মূলত তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে।

ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষা করাই এর লক্ষ্য। এতে যে বেকারত্ব দূরীভূত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার বেশিরভাগ স্বল্পোন্নত দেশে (বাংলাদেশের মতো) নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ভূমিকা রাখছে নানাভাবে। 
অর্থনীতি ডেস্ক

×