ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

বন্যায় আর্থিক ক্ষতি ও উত্তরণ

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বন্যায় আর্থিক ক্ষতি ও উত্তরণ

প্রতিবছরই বাংলাদেশে গ্রীষ্মের শেষার্ধ থেকে শরতের প্রথমার্ধে বন্যা দেখা দেয়

প্রতিবছরই বাংলাদেশে গ্রীষ্মের শেষার্ধ থেকে শরতের প্রথমার্ধে এক বা একাধিকবার বন্যা দেখা দেয়। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বৃষ্টিবহুল অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষাকালে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা নদীপথে গড়িয়ে এসে সমতলের বাংলাদেশে বন্যা ঘটায়। বার্ষিক এই প্লাবন বঙ্গীয় বদ্বীপের ফসলি জমির উর্বরতা যেমন রক্ষা করে, তেমনই অভ্যন্তরীণ ভূমির উচ্চতা বাড়ায় ও উপকূলীয় ভূমির সম্প্রসারণ ঘটায়।

নদীর সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্ক রক্ষা করে; মৎস্যসম্পদের আবাসন ও প্রজনন প্রক্রিয়াও সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা কিভাবে জীবন ও সম্পদ বিনাশী হয়ে উঠতে পারে সে চিত্র প্রতিবছরই কমবেশি দেখা যায়।

বিভিন্ন নদী অববাহিকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে ১১২টি পানিস্তর পরিমাপক স্টেশন রয়েছে; পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের বন্যা মানচিত্রে চার রঙের সূচক থাকে। যেমন- সূচকের রং ‘সবুজ’ মানে নদীপ্রবাহ স্বাভাবিক; বন্যার ঝুঁকি নেই, নদীর প্রবাহ যদি বাড়তে শুরু করে এবং বিপদসীমার নিচেই থাকে, তাহলে সূচকের রং হবে ‘হলুদ’, বিপদ সীমায় পৌঁছলে বা বন্যা দেখা দিলে সূচকগুলো ‘কমলা’ রং ধারণ করবে এবং প্রবল বন্যা দেখা দিলে ‘লাল’ হয়ে যাবে।

মাত্র সপ্তাহখানেক আগেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানিস্তর পরিমাপক স্টেশনগুলোর সূচক ছিল লাল ও কমলা। মধ্যাঞ্চলের সূচকগুলো ছিল হলুদ। এখন যখন সব সূচকই সবুজ, তখন কি আমরা আশ্বস্ত হব?
 শনিবার (৩১ আগস্ট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা যায়, সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। কৃষিখাত এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে গেছে, যা খাদ্যনিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এ ছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক এলাকায় মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ত্রাণ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছে এবং খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করছে।

তবে, পরিস্থিতির তীব্রতার কারণে এই প্রচেষ্টা এখনো অপর্যাপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। 
 দেশে বন্যার প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, উজান থেকে কী পরিমাণে পানি আসছে। দ্বিতীয়ত, কত দ্রুত বা ধীরগতিতে পানি আসছে আর কতদিন ধরে সেই পানি বাংলাদেশে থাকছে। তৃতীয়ত, দেশের নদী-নালা-খাল-বিলে পানির ধারণক্ষমতা। উজানের ভারতীয় অঞ্চলে এবং দেশের ভেতরের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ তিন ক্ষেত্রেই জটিলতা বেড়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে।

বিশেষত উজান থেকে আসা পলির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশের গভীরতা কমে নদীর পাড়ভাঙন বাড়ছে। আবার শুকনো মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরিবহনক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে এ পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে ফেলছে। আবার দেশের ভেতরের নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া ও চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণেও দিন দিন বন্যা বাড়ছে। এসব সংকটের সমাধান করতে না পারলে বন্যার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলবে না।

বন্যা মোকাবিলায় সব কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। এটি একটি আপৎকালীন অবস্থা, যা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই আরও খারাপ হয়েছে। পুকুর, খাল ও হাওড় যেগুলো একসময় এ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং বন্যার সময় অতিরিক্ত পানির জলাধার হিসেবে কাজ করত, গত কয়েক দশকে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ সরকারি নীতির কারণে এমনটা হয়েছে। ওই এলাকায় অনেক নদ-নদীও দখল করা হয়েছে। এতে গ্রীষ্মকালে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উপচে পড়ে। দেশের প্রধান নদীগুলোকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা নিতে হবে। বছর বছর নদী খননের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সে অনুপাতে কাজ হয় না।

দেশের নিম্ন এলাকার মানুষকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে হলে লোক দেখানো নদী খননের কাজ বন্ধ করতে হবে। টেকসই ও পরিকল্পিত উপায়ে নদী খননে পদক্ষেপ নিতে হবে।  বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই সংকটের সময়ে সহায়তার জন্য তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। 
সাম্প্রতিককালের বন্যাগুলোর ভয়াবহতা বৃদ্ধির বেশ কিছু মানবসৃষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা এবং অতিবৃষ্টির সময় হঠাৎ বাঁধের সব পানি ছেড়ে দিয়ে বাঁধের ভাটির জনপদে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করা।

যেমন পদ্মা নদীর উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধ থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বাঁধের সব দরজা খুলে দিয়ে পদ্মা ও তিস্তা নদীর উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ, যার অবস্থান এখন সপ্তম।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম যা ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে যা জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে, আঞ্চলিক সমন্বয় বাড়াতে হবে।

আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে বন্যার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে এবং দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যা প্রতিরোধে আন্ত:নদী পানিপ্রবাহ সংযোগসহ যে সকল আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে তার সফল প্রয়োগ সময়ের দাবি বিশেষত: ভারত ও চীনের সাথে।

এখন পর্যন্ত গঙ্গা চুক্তির সুফল আমরা তেমন কিছুই পাইনি এবং যা হয়েছে তা হলো শুষ্ক মৌসুমে আমরা মৃত পদ্মা পেয়েছি। যা রাজশাহী অঞ্চলের মরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে। এখন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে কূটনীতিতে বিশেষতঃ ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে যে সফলতা দেখিয়েছে তা আরও জোরদার করতে হবে।

সর্বশেষে বলা যায়, আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির যে অঞ্চলগুলো বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে তা নিয়ে সরকারের নির্ভীক ভবনা জোরদার করতে হবে। এখন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বৃহৎ নদনদীগুলোর দ্বারা বন্যাকবলিত দুই তীরের জনপদের জীবন জীবিকার স্বার্থে সরকার যদি এগিয়ে আসে তবে আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে, ভৌগোলিকভাবে মানুষ তার ভিটেবাড়ি কম হারাবে এবং দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচি আরও সফল হবে।

×