ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

ব্যাংকিং খাতে সংস্কার

মো. মাঈন উদ্দীন

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ২৪ আগস্ট ২০২৪

ব্যাংকিং খাতে সংস্কার

ব্যাংকিং খাতে সংস্কার

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দায়িত্ব হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা। আমদানি-রপ্তানিতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত গণআকাক্সক্ষার বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে নতুন প্রজন্ম যে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে, তাকে সবাই দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে উল্লেখ করেছে।

এ স্বাধীনতার সুফল অর্জনের জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় কতদিন তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবুও প্রত্যাশা তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। আমাদের অর্থনীতিতে অনেক ক্ষত তৈরি হয়েছে। কালোবাজারি ও খেলাপি গ্রাহকদের মুখোশ উন্মোচন করে দেশপ্রেমিক ও অভিজ্ঞ চৌকস অফিসারদের উপযুক্ত পদে আসীন করতে হবে। 
আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার
ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা, ব্যাংকিং কমিশন গঠন, আমদানি-রপ্তানির স্বাভাবিক পরিবেশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিকে নজর দেওয়া। রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা আনা, বাজারে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে ধাপে ধাপে।

অর্থনীতিতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা এত সহজে  কাটবে না। এর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্যই দেশের পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও অভিজ্ঞ সচিবদের সঙ্গে মতবিনিময় করা যেতে পারে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ ও  সম্ভাবনা রয়েছে। 
আর্থিক খাতে সংস্কার 
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাত দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। দেশের প্রকৃত অবস্থা আড়ালে ছিল এতদিন। এগুলো এখন পর্যায়ক্রমে বের হচ্ছে, সরকারের উচিত অর্থনীতির ক্ষতগুলো চিহ্নিত করে কোন কোন সেক্টরে বেশি ক্ষতি হয়েছে তা জরুরিভাবে সমাধানের ব্যবস্থা করা। ব্যাংকিং খাত হলো অর্থনীতির মেরুদ-। বিগত সরকার এই মেরুদ-কে ভেঙে দিয়েছে।

বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে বিরাজ করছে তারল্য সংকট। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যাংকিং কাজে অনতিবিলম্বে সুশাসন ফিরিয়ে আনা। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। দুর্বৃত্তদের ব্যাংকের বিভিন্ন পদ থেকে বিদায় করা। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক করা। বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা।

গ্রামীণ অর্থনীতি ও তৈরি পোশাক খাতে সাপ্লাই চেইন ঠিক করা। পত্রিকা থেকে জানা গেছে, সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের ঋণ সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকার ও বেশি। পাচার হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাচার হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে হিসাব রয়েছে তাও ঠিক করা উচিত। রিজার্ভ এখন থেকে আশা করি বাড়বে। তবে বিগত দিনগুলোতে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তা যাতে না হয় সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দেশের আরেকটি সমস্যা হলো কাক্সিক্ষত মানের রাজস্ব আদায় না হওয়া। কোনো বছরেই রাজস্ব আদায় সঠিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয় না।

এতে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে সরকারি ও বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বিগত সরকারের বাজার সিন্ডিকেট, সড়কে চাঁদাবাজি, অবৈধ দালাল ও মধ্যস্বত্ব¡ভোগীর অধিক বিস্তার ছিল। বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল। এসব সিন্ডিকেটের দোরাত্ম্য থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।

কঠোর হস্তে দমন করতে হবে চাঁদাবাজদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ এবং ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) শেষ হয়েছে। আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তাই নয় সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও নেতিবাচক ধারাতে রয়েছে অনেক দিন ধরে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত।

কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। সংবাদপত্রে  প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী কনট্রাক্টরদের অর্থ এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। বিদেশ থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ আমদানি করেছি, সে ক্ষেত্রেও কিছু অংশ বকেয়া রয়েছে। এগুলো তো বাংলাদেশকে শোধ করতে হবে। আর শোধ করতে গেলে দেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়বে, তাও সামলাতে হবে। 
ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বাংলাদেশকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে আমদানি-রপ্তানিতে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা পুনরুদ্ধারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের ও  রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের যে হিসাব তাতে অনেক গরমিল রয়েছে। যেমন ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব ইত্যাদি। ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে হলে বৈদেশিক বাণিজ্যের সমস্যা দূর করতে হবে। অর্থপাচার রোধ ও বৈধ পথে রেমিটেন্স আনতে হবে।

×