ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৪ আগস্ট ২০২৪

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

শ্রমঘন এ দেশে জুতসই একটি কাজ খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের যোগ্যতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পছন্দমতো চাকরি করা অনেক মানুষের সারা জীবনের আকাক্সক্ষা। শিক্ষাজীবন থেকেই শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত থাকে ভবিষ্যতে কী কাজ করবে, কোন ধরনের চাকরি করবে, তা নিয়ে। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকে সরকারি কোনো উচ্চ পদে চাকরির জন্য।

সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা করপোরেশনে চাকরি করার ক্ষেত্রে অধিকতর মেধাবীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে শিক্ষাজীবন থেকেই। এখানে দোষের কিছু নেই, নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলে কেউ যদি যথাযোগ্য চাকরি পায়, তখন সে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে কর্মক্ষেত্রে, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই।

কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে একনায়কত্ব, কাজ সৃষ্টিতে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক দৌব বিত্তায়ন যুব ছাত্র সমাজের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, যা থেকেই কোটা আন্দোলন ও সরকারের পটপরিবতর্ন। এখন যুব আন্দোলন বেষ্টিত কেয়ার টেকারের পর সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা অনেক এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রত্যাশা পূরণ সহজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ আগে পরিবেশ সৃষ্টি, তারপর ইলেকশন, গণতন্ত্রের পুনজাগরণ সময় সাপেক্ষ যা সরকারের আলাপ আলোচনা থেকে অনুধাবন করা যায়।
বিগত এক মাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া আন্দোলন এবং তার দমন ঘিরে অর্থনীতির ক্ষতির দিকটায় চোখ দেয়া যাক। প্রথমত, তথ্যমতে আন্দোলন চলাকালে দেশের অর্থনীতিতে প্রতিদিন এক বিলিয়ন ডলার করে গড়ে ছয় বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না হওয়ায় ক্ষতির অঙ্ক বেড়ে সাত বিলিয়ন ডলারও হতে পারে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে, তৈরি পোশাক, যোগাযোগ, ই-কমার্স, পর্যটনসহ স্থানীয় উৎপাদনমুখী খাত। এ সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানিকারকদের। কাজ হারিয়েছেন ফ্রিল্যান্সাররা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যারা দিন আনে দিন খায় তারাও। এর বাইরে যারা ধনী, তারাও হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত।

বিশেষ করে যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের কল-কারখানা বন্ধ থাকার পরও বেতন দিতে হয়েছে। সাপ্লাই চেইনে চরম ব্যাঘাত ঘটেছে। এর চ্যালেঞ্জ এখন বহুমুখী। টেকসই সমাধান না হলে আবার কী হয়, সে চিন্তা তো সবার আছেই। তৃতীয়ত,  বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রা আয়ের বড় অংশীদার পোশাক খাত। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে।

বাংলাদেশের চলমান অস্থিরতার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় চার দিনে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। ২৮ মাসের ওপরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে গড় মজুরি কম। অর্থাৎ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অর্থনীতির পরিভাষায় গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি হলে সেটি দেশের অর্থনীতির দুরবস্থাকেই ইঙ্গিত করে। 
এখন প্রত্যাশার প্রশ্ন আসলেই প্রথমেই আসে জনগণের জীবন-জীবিকা যা দীর্ঘ দিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হবে বর্তমান সরকারকে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা, ডলার সংকট মোকাবিলা করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো।

দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব খাতে লক্ষ্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং। এসবের পাশাপাশি আরও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইএমএফের শর্তের বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব মোকাবিলা। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে আস্থার সঞ্চার করা, রেমিটেন্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক অবস্থায় আনা।

এ ছাড়া টাকা পাচার রোধ এবং হুন্ডির প্রভাব কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ হ্রাস, ডলার সংকট ও সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের গতিও কম। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণও কম হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।

এতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে বিনিয়োগ। রাজস্ব আয় না বাড়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট থাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে ঋণের জোগান দিতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায়ও ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশে আর্থিক সংকট প্রকট হচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপরও চাপ বাড়ছে। তাই অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক সময় প্রয়োজন হবে।  
অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও বড় একটি জঞ্জাল সাফ করায় অন্তর্বর্তী সরকারকে হাত দিতে হবে তা হলো, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ঘটে যাওয়া দুর্নীতির বিচার। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর এখনই সময়। কারণ বিরল ও অভূতপূর্ব ঘটনা অর্থনীতির জগতে এই প্রথম। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান, অর্থ উপদেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।

তারা তিনজনই অর্থনীতিবিদ ও প্রতিষ্ঠিত গবেষক। এটা আগে কখনো বাংলাদেশে ঘটেনি। সরকার প্রধানের কথা বাদ দিলাম, ইতোপূর্বে অর্থমন্ত্রীদেরও সম্ভবত একজন বাদে আর কেউ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। গভর্নর পদে আমলাদেরই প্রাধান্য ছিল, যদিও একবার বা দুবার ব্যাংকাররা গভর্নর হয়েছেন, সম্ভবত দু’বার অর্থনীতিবিদ গভর্নর হয়েছেন। এরই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, অর্থনীতি আজ অর্থনীতিবিদদের হাতে।

যারা এতদিন বাইরে থেকে কথা বলতেন, পরামর্শ দিতেন, উপদেশ দিতেন, সমালোচনা করতেনÑ তারাই আজ দেশের অর্থনীতির মূল কর্তা। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তাদের আর পরামর্শ দিতে হবে। তারা অর্থনীতি, ব্যাংকিং এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার কথা জানেন। সমাধানের পথও তাদের জানা। দ্বিতীয়ত, তিন জনই মিডিয়ার পরিচিত মুখ।

তাদের আরও সুবিধা এই যে, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা, প্রতিষ্ঠান ও বিদেশী সরকারগুলোর কাছেও পরিচিত। সবচেয়ে বড় কথা, এ মুহূর্তে তাদের শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা। অতএব, দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হবে না। এজন্য অর্থনৈতিক নেতৃত্বের কাছে জাতির আশা অনেক বেশি।

বাকিটা ভবিষ্যৎ বলবে। নতুন নিযুক্ত অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, কৃষকের সার, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারি আমদানিতে গুরুত্ব দেবেন। তিনি অর্থনৈতিক খাত সচল করতে এবং অস্থিরতা কমিয়ে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চান। বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে সম্ভব নয়Ñ যদিও এটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক ভালো করার তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে চান অর্থ উপদেষ্টা।

×