ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বাড়বে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ

দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে হচ্ছে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ২৬ জুলাই ২০২৪

দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে  হচ্ছে অর্থনৈতিক  অংশীদারিত্ব চুক্তি

.

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রেরণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কোরিয়ার সঙ্গে বর্তমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যার সিংহভাগই আমদানির বিপরীতে ব্যয় হচ্ছে। তবে দেশটিতে ধীরে ধীরে বাড়ছে পোশাক রপ্তানি। চিকিৎসা, তথ্য প্রযুক্তি, রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল এবং এদেশের বড় বড় অবকাঠামোতে কোরিয়ার বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের বেসরকারি খাতে বিপুল অঙ্কের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে কোরিয়ার। বাস্তবতায় চলতি বছরের মধ্যে কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-ইপিএ) করতে চায় সরকার।

বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহুমাত্রিক। বিশেষ করে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে দেশটিতে। গত কয়েক বছর ধরে কোরিয়ায় পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। পোশাকের পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যান্য রপ্তানিপণ্য যেমন প্লাস্টিক, কৃষিজাতপণ্য কাঁকড়া কুইচ্যা, হিমায়িত চিংড়ি অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে ইপিএ করা হলে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। এলক্ষ্যে দুদেশ নিজ উদ্যোগে সম্ভাব্য সমীক্ষা পরিচালনার জন্য একটি গবেষণা টিম গঠন করে। টিমটি শীঘ্রই তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সম্ভাব্য সমীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়েই উভয়দেশকে ইপিএ করার উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে। এদিকে, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য গত বছর নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। আগের বছরের তুলনায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে ২০২২ সালে বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।

কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দশমিক ০৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে বাণিজ্য ছিল দশমিক ১৮৮ বিলিয়ন ডলার। দেশটিতে বাংলাদেশেরর প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো তৈরি পোশাক খেলাধুলার সামগ্রী। ছাড়া বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ জোরদারে চুক্তি সই করেছে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই কোরিয়া ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (কোইমা) প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ, পিটিএ, সেপা, ইপিএ এবং আরসেপ নামে চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে এলডিসি উত্তরণের পরও আমরা রপ্তানিতে কোনো বাধার সম্মুখীন হবো না। বিশেষ করে রপ্তানিতে শুল্ক বাজার সুবিধা থাকার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, কোরিয়া বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক অংশীদার। সে হিসেবে দেশটির সঙ্গে ইপিএ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়বে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এদিকে, কূটনৈতিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থান ভূরাজনীতি বাংলাদেশের প্রতি দক্ষিণ কোরিয়াকে আকৃষ্ট করছে। তাই অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা বা কৌশলগত সাংস্কৃতিক সবদিকেই সম্পর্ক আরো নিবিড় করার পথে দেশটি। সম্পর্কের শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরেই, গত পাঁচ দশকে যা ক্রমেই  বেড়েছে। অতিসম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্পেও বড় আকারের ঋণ চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। কোরীয় দাইয়ু কোম্পানির প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের হাত দিয়েই ১৯৭৮ সালে যাত্রা করে দেশের প্রথম রফতানিমুখী পোশাক শিল্প। কালক্রমে যাত্রা করে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অন্যতম প্রথম বিদেশী কোম্পানি ইয়াংওয়ানও। সেটিও কোরীয় প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার দেশটিও দক্ষিণ কোরিয়া।

অতিসম্প্রতি বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচিরও  ঘোষণা এসেছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব আরও নিবিড় হচ্ছে। ছাড়া এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি গতি পেয়েছে। সময়ের মধ্যে দেশটি ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) আওতায় দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ রয়েছে এমন খাতগুলোর মধ্যে আছে বস্ত্র পোশাক, চামড়া চামড়াজাত পণ্য, ব্যাংকিং, সিমেন্ট, নির্মাণ, বিদ্যুৎ, খাদ্য, মেটাল মেশিনারি পণ্য এবং রাসায়নিক খাত প্রভৃতি।

পণ্য আমদানি রফতানির মাধ্যমে কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেকদিনের। পর্যায়ক্রমে  বেড়েছে বিনিয়োগ প্রবাহ। সাম্প্রতিক সময়ে ইলেক্ট্রনিকস, অটোমোবাইল অবকাঠামো খাতে দেশকে ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে কোরীয়দের। কয়েক বছর হলো স্যামসাং এলজির মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ইলেক্ট্রনিক পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে। চলতি বছর অটোমোবাইল সংযোজন  শুরু করেছে হুন্দাই। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েও এগোচ্ছে কোরীয় প্রতিষ্ঠানটি। অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের অংশ হিসেবে ব্যাপ্তি বাড়াতে চায় বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতেও। সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার আভাস মিলছে। কয়েক বছরে দেশে অবকাঠামো খাতের বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে কোরীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ইপিজেডের যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। সেই সময় থেকে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতায় তিন শতাধিক  কোম্পানি ইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ৭৩টি কোম্পানিই দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক। কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষের। কেবিসিসিআই সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে দক্ষিণ  কোরিয়া।

উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে সিলেট এয়ারপোর্ট, ঢাকা ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্টে হুন্দাই রোটেম, পদ্মা সেতু সুপারভিশনে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন প্রভৃতি। এদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর জোর দিয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়াং-সিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দপ্তরে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সময় তাঁদের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি, কোরিয়া পরিচালিত প্রকল্প, চুক্তি, প্রযুক্তি বিনিময়সহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তির (ইপিএ) মতো দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থাকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

×